ইতালির দ্বীপ সিসিলির উপকূলে গত সোমবার একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরি (ইয়ট) ডুবে যাওয়ার ঘটনায় ব্রিটিশ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাইক লিঞ্চ, তাঁর মেয়ে হান্না লিঞ্চসহ সাতজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনা কীভাবে ঘটল বা এর পেছনে কারও হাত আছে কি না, ইতালির কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রমোদতরিটি মাত্র ৬০ সেকেন্ডেই ডুবে যায়। কিন্তু এত বড় একটি প্রমোদতরি কীভাবে এত অল্প সময়ে ডুবতে পারে?
বায়েসিয়ান নামের ওই প্রমোদতরি ডুবে যাওয়ার আগে তোলা এক ছবিতে দেখা যায়, সেটি পোর্টিসেলো উপসাগরের শান্ত জলে নোঙর করা হয়েছে। এর ওপর ৭৫ মিটার মাস্তুল। মাস্তুলের পেছনে বিশাল কালো মেঘ জমে রয়েছে। সিসিলির পালের্মো থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের জেলেদের গ্রাম পোর্টিসেলোর এক রেস্তোরাঁর মালিক গত রোববার ওই ছবি তোলেন। ওই ছবিই সম্ভবত ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে প্রমোদতরিটি ডুবে যাওয়ার আগের শেষ ছবি।
যুক্তরাজ্যের বিল গেটস হিসেবে বর্ণনা করা হয় মাইক লিঞ্চকে। কোম্পানি বিক্রির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে হওয়া একাধিক জালিয়াতির মামলা থেকে গত জুনে খালাস পান মাইক। এরপর তিনি নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিলেন। তাই স্ত্রী অ্যাঞ্জেলা ও মেয়ে হান্নাকে নিয়ে নিজের মতো করে উদ্যাপন করতে বের হয়েছিলেন তিনি। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন লিঞ্চের অ্যাটর্নি আইনি প্রতিষ্ঠান ক্লিফোর্ড চ্যান্সের ক্রিস মরভিলো ও মরগান স্ট্যানলি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান জোনাথন ব্লুমার, তাঁদের স্ত্রীসহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা বিলাসবহুল ব্রিটিশ পতাকাবাহী বায়েসিয়ান প্রমোদতরিতে সিসিলির চারপাশে সমুদ্রযাত্রা উপভোগ করছিলেন। ৫৬ মিটার প্রমোদতরিটি আঠারো শতকের গণিতবিদ থমাস বায়েসের নামানুসারে রাখা হয়। ধারণা করা হয়, থমাস বায়েসের কাজে প্রভাবিত হন লিঞ্চ।
প্রমোদতরিটি নেদারল্যান্ডসের রটারডাম থেকে যাত্রা শুরু করে। গত সপ্তাহে এটি জিব্রাল্টার প্রণালি অতিক্রম করে সিসিলি উপকূলে পৌঁছায়। ১৮ আগস্ট রোববার তাঁদের প্রমোদতরিটি মিলাজ্জো বন্দরে থামার পর পোর্টিসেলোতে এসে নোঙর করে।
স্থানীয় মৎস্যজীবী ফ্যাবিও সেফাল (৩৬) বলেন, তাঁরা বড় প্রমোদতরি দেখে অভ্যস্ত হলেও বায়েসিয়ান তাঁদের মুগ্ধ করেছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, এটা হয়তো হলিউডের কোনো তারকার বা প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের হতে পারে। যদিও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ঝড়ের কথা আগেই জেনেছিলেন, তারপরও মাছ ধরার জন্য মাঝরাতে ঘুম থেকে ওঠেন সেফাল। তিনি রাত সাড়ে তিনটার দিকে বন্দরে যান। তখন আকাশে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী সেফাল বলেন, ‘৩টা ৫৫ মিনিটের সময় ছোটখাটো ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল। আমি জীবনে অনেক ঝড় দেখেছি, কিন্তু এমন ঝড় আগে দেখিনি। কাছের পানশালার সব চেয়ার-টেবিল উড়ে গেল। এরপর ঘূর্ণিঝড় পোতাশ্রয়ের দিকে এগোতে শুরু করল। এরপর ঘূর্ণিঝড় দিক বদলে প্রমোদতরির দিকে এগোতে শুরু করল।’
সেফাল আরও বলেন, ঘূর্ণিবাতাস ও ঢেউয়ে মারাত্মকভাবে দুলছিল প্রমোদতরিটি। বায়েসিয়ানে তখন পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করল। বায়েসিয়ানের কাছাকাছি মাত্র ১৫০ মিটার দূরে ছিল নেদারল্যান্ডসের পতাকাবাহী আরেক জাহাজ স্যার রবার্ট ব্যাডেন। ১৯৫৭ সালে তৈরি জাহাজটি সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন ৬৯ বছর বয়সী দক্ষ ও অভিজ্ঞ নাবিক ক্রার্স্টেন বর্নার।
যদি সেই রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করত, ঝড়ের দিনে বিশ্বের কোন পালতোলা নৌকায় আমি থাইতে চাইব, আমি বায়েসিয়ানকে বেছে নিতাম।গ্যাব্রিয়েল ব্রুনি, নাবিক, ইতালি
ক্রার্স্টেন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমি প্রথমেই আমাদের জাহাজের ইঞ্জিন চালু করে দিই, যাতে জাহাজ স্থির থাকে। আমাদের জাহাজকে নিরাপদ করার পর আমরা বায়েসিয়ানের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাই।’
স্থানীয় আরেক জেলে ওই সময় ছবি তোলেন। তাঁর তোলা এক ছবিতে দেখা গেছে, ৪টা ৩৫ মিনিটের দিকে বায়েসিয়ান থেকে লাল রকেট ফ্লেয়ার জ্বালানো হয়েছিল। ফ্রান্সেসকো লো কোকো নামের ওই জেলে বলেন, ‘আমি জাহাজটিকে দুলতে দেখেছি। ডোবার সময় সেখান থেকে জরুরি রকেট ছোড়া হয়।’
স্যার রবার্ট ব্যাডেনের ক্যাপ্টেন ক্রার্স্টেন বর্নার প্রথম বায়েসিয়ানকে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন; কিন্তু ততক্ষণে বায়েসিয়ান ডুবে যায়। তিনি বলেন, ‘এত বড় নৌযানকে আমি এত দ্রুত কখনো ডুবে যেতে দেখিনি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবকিছু নেই হয়ে গেল। এরপর আমরা ১৫ জনের একটি ভেলা দেখতে পেলাম। তাঁদের উদ্ধার করা হয়।’
শিপইয়ার্ডের সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও থেকে ধারণা করা হয়, বায়েসিয়ানে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের বাঁচাতে ১৬ মিনিট সময় পেয়েছিলেন।
ইতালীয় বার্তা সংস্থা অ্যাডনক্রোনোস জানিয়েছে, যাত্রীরা প্রমোদতরিটির উল্টো দিকে পালানোর পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু পানি তাঁদের কেবিনে ঢুকে পড়েছিল। প্রমোদতরিটির গলুইয়ের দিকটি প্রথমে ডুবে যায়। এরপর এটি ডান দিকে কাত হতে শুরু করে।
প্রমোদতরিটি ডুবে যাওয়ার পরদিন ইতালির প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে এটি স্থান করে নেয়। এতে বলা হয়, প্রমোদতরিতে থাকা ২২ যাত্রীর মধ্যে ১৫ জন উদ্ধার হয়েছেন। গত সোমবার সকালে ইতালির কর্তৃপক্ষ জানায়, লিঞ্চসহ সাতজন নিখোঁজ রয়েছেন। এ ঘটনা দ্রুত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চলে আসে।
বেঁচে যাওয়া ১০ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, যাঁদের মধ্যে শার্লট ও তাঁর এক বছর বয়সী সন্তানও ছিল।
পের্টিসেলোর আরেক জেলে বলেন, দ্রুতই বায়েসিয়ান জাহাজটি ডুবে যায়। কারণ, এটি ভুল সময়ে ভুল স্থানে ছিল। কিন্তু ইতালির কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে শুরু করেছে। প্রমোদতরির ক্যাপ্টেন ও ক্রুরা যথাযথ নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তাঁরা। এটি কোনো খুনের ঘটনা কি না, তা খতিয়ে দেখতে চাইছেন তাঁরা।
বায়েসিয়ানের মতো প্রমোদতরি কীভাবে মাত্র ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে ডুবে যেতে পারে, তা চমকে দিয়েছে বিশেষজ্ঞদের। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রমোদতরির কর্মীরা আবহাওয়ার সতর্কবার্তাকে গোনায় ধরেননি।
নাবিক গ্যাব্রিয়েল ব্রুনি বলেন, ‘যদি সেই রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করত, ঝড়ের দিনে বিশ্বের কোন পালতোলা নৌকায় আমি থাইতে চাইব, আমি বায়েসিয়ানকে বেছে নিতাম।
দুর্ঘটনার পর সোমবার সকাল থেকে দ্রুত উদ্ধারকাজ শুরু হয়। সেদিন দুপুরেই পাওয়া যায় শেফ রিকালডোর মরদেহ। বুধবার সকালে আরও দুজনের মরদেহ পাওয়া যায়। জানা যায়, মরদেহ দুটি ব্লুমার ও মরভিলোর। বিকেলে তাঁদের স্ত্রীদের মরদেহ পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় পাওয়া যায় লিঞ্চের মরদেহ। শুক্রবার ডাইভাররা পানির নিচে সর্বশেষ লিঞ্চের মেয়ে হান্নার মরদেহ খুঁজে পান।
বাবার মতোই হান্না নিজের জীবন ওই রাতে উদ্যাপন করতে চেয়েছিলেন। গত সপ্তাহে তাঁর এ-লেভেলের ফল বেরিয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন হান্না।
ঠিক তাঁর বাবার মতো হান্না তাঁর জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের শুরুতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রীষ্মের এক রাতে তাঁদের জীবন হঠাৎ করে থেমে গেল। এর কারণ ইতালীয় তদন্তকারীরা এখন বোঝার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।