ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের একটি সড়কে রুশপন্থী বাহিনীর ট্যাংক
ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের একটি সড়কে রুশপন্থী বাহিনীর ট্যাংক

বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা

ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পশ্চিমাদের জন্য ঝুঁকির কারণ হবে

ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে এই যুদ্ধ সহসাই থামবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ চললে তা ইউক্রেনের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশ্লেষকেদের অনেকেই সতর্ক করে বলেছেন, যেসব দেশ ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চললে সেসব দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ হতে পারে। বিশেষত যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়লে ও অর্থনৈতিকসংকট জোরদার হলে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সেসব দেশও রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে।

আরেকটি ঝুঁকি হলো তাইওয়ান পরিস্থিতি। তাইওয়ানকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা সীমা ছাড়ালে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমতে পারে। তাই যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির জন্য আলোচনা এগিয়ে নিতে এই পরিস্থিতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ওপর চাপ বাড়াতে পারে বলেও বিশ্লেষকদের অনেকের মত।

এ বিষয়ে প্যারিসভিত্তিক ফ্রেঞ্চ ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের (এফএসআর) গবেষক ব্রুনো টার্টরেইস বলেন, ‘পরিস্থিতি বেশ জটিল। চীন আগের চেয়ে বেশি আগ্রাসী আচরণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালে ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তি আবারও ক্ষমতায় আসতে চাইছেন। ইউরোপেও জনতুষ্টিবাদী নেতাদের জনসমর্থন পোক্ত হচ্ছে। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে আগামী ছয় মাসে যা–ই ঘটুক না কেন, সামরিকভাবে রাশিয়াই এগিয়ে থাকতে পারে।’

পরিস্থিতি বেশ জটিল। চীন আগের চেয়ে বেশি আগ্রাসী আচরণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালে ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তি আবারও ক্ষমতায় আসতে চাইছেন। ইউরোপেও জনতুষ্টিবাদী নেতাদের জনসমর্থন পোক্ত হচ্ছে। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে আগামী ছয় মাসে যা–ই ঘটুক না কেন, সামরিকভাবে রাশিয়াই এগিয়ে থাকতে পারে।
ব্রুনো টার্টরেইস, ফ্রেঞ্চ ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের (এফএসআর) গবেষক।

জ্বালানিসংকটের কারণে এবারের শীতে ইউরোপবাসীর জীবন বিপর্যস্ত হতে পারে। সেই সঙ্গে রয়েছে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম, যা জীবনযাপনের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইউরোপবাসীর মনে ইউক্রেনীয়দের জন্য আবেগ কমতে শুরু করেছে। চলতি মাসে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁদের মতে, চেক সরকার ইউক্রেনীয়দের দুর্দশা নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এর প্রমাণ।

এমন মনোভাব ইউরোপের আরও অনেক দেশের মানুষের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। নিজেদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছেন। এ বিষয়ে ফরাসি নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইপিএসই ইউরোপিয়ানের গবেষক ইমানুয়েল দুপুইয়ের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি ইউরোপজুড়ে ‘ইয়েলো বেস্ট’ আন্দালনের মতো নতুন বিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। অনেক দেশের নেতৃত্বকে নতুন করে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে মস্কোর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা উল্টো ফল দিতে পারে। এর ফলে অনেক ইউরোপীয় কোম্পানির রাশিয়ায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এসব কোম্পানি মন্দার মুখে পড়তে পারে, যা ইউরোপের অর্থনৈতিকসংকট আরও জোরালো করবে। এর সঙ্গে রয়েছে শীত শুরুর আগেই ইউরোপে রুশ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিঘাত।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পেছনে অর্থ ব্যয়ের চেয়ে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যয় করতে বেশি পছন্দ করবে। কেননা, চীনের আগ্রাসী আচরণ নিয়ে এখন মার্কিন প্রশাসন বেশি উদ্বিগ্ন।
চার্লস পাওয়েল, স্পেনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এলকানো’র পরিচালক।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে বিলিয়ন ডলারের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে আসছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন এই সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হলে তা মার্কিন প্রশাসনের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্পেনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এলকানো’র পরিচালক চার্লস পাওয়েল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পেছনে অর্থ ব্যয়ের চেয়ে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যয় করতে বেশি পছন্দ করবে। কেননা, চীনের আগ্রাসী আচরণ নিয়ে এখন মার্কিন প্রশাসন বেশি উদ্বিগ্ন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না

চীনের সঙ্গে বিরোধ প্রসঙ্গে ইউরোপে মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার জেনারেল বেন হগজ বলেন, ‘একটি সংঘাত আসছে। আমি জানি না কবে, তবে তা পাঁচ বছরের কম সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান হতে পারে।’

এর আগেই ২০২৪ সালে ওয়াশিংটনের মসনদে আবারও বসার জন্য কার্যক্রম শুরু করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মস্কোর সঙ্গে সংযোগ ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিষয়ে তাঁর অভিমত কারও অজানা নয়। তাই হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের পুনরুত্থানে ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যা শেষ অবধি রাশিয়ার জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে।