ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলো মুক্ত করতে গত জুন থেকে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। প্রায় হাজার কিলোমিটারের সম্মুখসারিতে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ চলছে রুশ সেনাদের ওপর। এই পাল্টা হামলায় ইউক্রেনের দক্ষিণে বড় অগ্রগতির দাবি করেছেন দেশটির ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।
ইউক্রেনের দক্ষিণে জাপোরিঝঝিয়া শহরের দক্ষিণ-পূর্বের এলাকাগুলো রুশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত করাটা কৌশলগতভাবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকাগুলো থেকে আরও দক্ষিণ-পূর্বে আজভ সাগর পর্যন্ত দখলে নিতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। হামলায় সফলতা পেলে ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার রোস্তভ-অন-দন শহরের মধ্যকার রুশ সরবরাহ পথগুলো বিচ্ছিন্ন করা যাবে।
গুরুত্বপূর্ণ এই পথগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ক্রিমিয়ায় বিশাল সেনাবহর রক্ষণাবেক্ষণ রাশিয়ার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। তবে এ লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন অগ্রগতি পায়নি ইউক্রেন। জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে রাশিয়ার হাত থেকে শুধু রোবোতিন ও ভেরবোভ গ্রামের আশপাশের কিছু এলাকা মুক্ত করতে পেরেছে তারা।
ভেরবোভ গ্রামের কাছে যুদ্ধে সম্মুখসারি থেকে ধারণ করা ৯টি ভিডিও যাচাই করে দেখেছে বিবিসি। এর মধ্যে চারটি ভিডিওতে দেখা গেছে, গ্রামটির উত্তরে প্রতিরক্ষাবলয় ভেঙে রুশ নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় ঢুকছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। তবে তারা ওই এলাকা দখল করতে পেরেছে কি না, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তাই এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তা হলো, ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কিছুটা সফলতা পাচ্ছে। তবে ব্যাপক হারে তারা রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় প্রবেশ করতে পারছে না। এমনকি তেমন কোনো এলাকা নিজেদের দখলেও নিতে পারছে না।
যা ভোগাচ্ছে ইউক্রেনকে
ইউক্রেন যে এমন পাল্টা হামলা চালাবে, তা বহু আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল মস্কো। তাই ব্যাপক শক্তিশালী এক প্রতিরক্ষাবলয় গড়ে তুলতে মাসের পর মাস সময় নিয়েছে তারা। স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে দেখা গেছে, এই প্রতিরক্ষাবলয়ে রয়েছে পরিখা, বাংকার ও মাইনের মতো শত্রুপক্ষকে থমকে দেওয়ার নানা কৌশল। এগুলোকে আবার সুরক্ষা দিতে রয়েছে কামান। ট্যাংক থামাতে মাটিতে পোঁতা হয়েছে কংক্রিটের কাঠামো। এগুলোকে বলা হচ্ছে ‘ড্রাগনের দাঁত’।
ইউক্রেন যে এমন পাল্টা হামলা চালাবে, তা বহু আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল মস্কো। তাই ব্যাপক শক্তিশালী এক প্রতিরক্ষাবলয় গড়ে তুলতে মাসের পর মাস সময় নিয়েছে তারা।
ইউক্রেনের অগ্রগতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার মাইনগুলো। সম্মুখসারিজুড়ে অসংখ্য মাইন পুঁতে রেখেছে রুশ বাহিনী। কিছু কিছু এলাকায় তো প্রতি বর্গমিটারে পাঁচটি পর্যন্ত মাইন থাকতে দেখা গেছে। এসবের কারণে পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও ইউক্রেন বাহিনী পাল্টা হামলা শুরুর পর ব্যর্থতার মুখে পড়ে। ভেস্তে যায় তাদের পরিকল্পনা। নিহত হন ইউক্রেনের বহু সেনা।
এর পর থেকেই কৌশলে পরিবর্তন আনে কিয়েভ। পদাতিক সেনাদের দিয়ে মাইনগুলো সরানো শুরু করে তারা। এ কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয় রাতের বেলা। এরপরও শত্রুপক্ষের গুলির মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। এখন পর্যন্ত এ কাজেও তেমন অগ্রগতি পায়নি ইউক্রেন।
রাশিয়ার মাইন, ড্রোন ও ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মুখে অনেকটা অসহায় ইউক্রেনের ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানগুলো। যেমন রোবোতিন গ্রামের কাছে যুক্তরাজ্যের সরবরাহ করা একটি চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক ধ্বংস হওয়ার ভিডিও সামনে এসেছে। ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করে দেখেছে বিবিসি।
এখন পাল্টা হামলায় সফলতা পেতে ইউক্রেনের সামনে উপায় কী? বলা চলে, আগে মাইনগুলো সরিয়ে পথ তৈরি করতে হবে। আর রাশিয়ার কামানগুলো নিষ্ক্রিয় করতে হবে। এরপরই ইউক্রেনীয় সেনারা ব্যাপক হারে রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবেন।
পাল্টা হামলার ভবিষ্যৎ কী
লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রুসির রাশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক কাতেরিনা স্তেপানেঙ্কো বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর বাধার মুখে পড়ছে ইউক্রেন। কামান, ড্রোন ও প্রতিরক্ষামূলক অন্য ব্যবস্থা ছাড়াও ইলেকট্রনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে রাশিয়া। এতে ইউক্রেনের রেডিও সংকেত ও ড্রোনের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো দখল করে উপকূলের দিকে যেতে হয়তো ১০ শতাংশের কিছু বেশি অগ্রগতি পেয়েছে ইউক্রেন। তবে তিন মাস ধরে চলা পাল্টা হামলায়, বিশেষ করে রাশিয়ার সরবরাহ পথগুলোয় ইউক্রেনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রুশ সেনারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের হতাশার মধ্যে পড়ারও সম্ভাবনাও রয়েছে।
ইউক্রেন যদি রাশিয়ার বাকি প্রতিরক্ষাবলয়গুলো ভেঙে দিতে পারে এবং তোকমাক শহরের কাছে পৌঁছাতে পারে, তাহলে ক্রিমিয়াগামী রাশিয়ার রেল ও স্থলপথগুলো ইউক্রেন বাহিনীর কামানের আওতায় চলে আসবে। শেষ পর্যন্ত তা-ই যদি হয়, তাহলে পাল্টা হামলার সফলতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকবে না।
ইউক্রেনের জন্য আরও কঠিন সময় আনতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে জিতে কোনো রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হলে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসহায়তা নাটকীয়ভাবে কমতে পারে।
এটি হয়তো যুদ্ধে ইতি টানবে না। তবে যুদ্ধ নিয়ে মস্কোর যে তৎপরতা, তাতে ভাটা পড়বে। আর যুদ্ধ থামাতে যখন শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে, তখন শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে ইউক্রেন। তবে পাল্টা হামলায় সফলতা পেতে ইউক্রেনের হাতে খুব বেশি সময় নেই। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশটিতে বর্ষাকাল শুরু হবে। তখন কাদার জন্য সামনে এগোনো ইউক্রেনের জন্য কঠিন হবে।
শুধু বর্ষাকালই নয়, ইউক্রেনের জন্য আরও কঠিন সময় আনতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে জিতে কোনো রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হলে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসহায়তা নাটকীয়ভাবে কমতে পারে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভালোভাবেই জানেন, সেই সময় পর্যন্ত ইউক্রেন বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। তাই ইউক্রেনের জন্য এখন সময়ের মধ্যে পাল্টা হামলায় সফলতা পাওয়াটা খুবই জরুরি।