সফল একটা সপ্তাহ পার করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। এই সাফল্য তিনি উদ্যাপন করতেই পারেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ওই সুসংবাদ সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, ঋষি সুনাককে তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, বালির ওপর তাঁর এই দুর্গ নির্মিত।
যুক্তরাজ্যের জন্য সুসংবাদটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ সপ্তাহে বলেছে, যুক্তরাজ্য মন্দার পথে নেই। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানির দাম পড়তির দিকে। তবে ঋষি সুনাকের চাওয়ার চেয়ে এই হার যথেষ্ট ভালো।
যুক্তরাজ্যের সবকিছু এখনো ঠিকঠাকমতো চলছে না। তবে ঋষি সুনাকের পূর্বসূরি লিজ ট্রাস যে জট পাকিয়েছিলেন আর অর্থনৈতিক যে জুয়া খেলেছিলেন, তাতে এক দশকের মধ্যে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছিল। ঋষি সুনাক দাবি করতে পারেন, পূর্বসূরির কাছ থেকে যে অস্থির পরিস্থিতিতে তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি সেই নড়বড়ে জাহাজকে কিছুটা সুস্থির করতে পেরেছেন।
তবে ঋষি সুনাকের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, তাঁর দল কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে এখনো চরম বিভক্তি রয়েছে। দলের সদস্যদের মধ্যে এখনো নানা বিষয় নিয়ে বনিবনা হচ্ছে না। তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরস্পরের বিপক্ষে লড়ছেন।
এক বছরও হয়নি যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং নানা কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও ডাউনিং স্ট্রিটে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে লড়ছিলেন। করোনা মহামারির সময় বিধি ভেঙে পার্টি করেছিলেন তিনি। তখন ঋষি সুনাক তাঁর চ্যান্সেলর (অর্থমন্ত্রী) ছিলেন। তিনিই বরিস জনসনের ওই কেলেঙ্কারি জেনে মন্ত্রিসভা ছেড়ে বরিস জনসনের ক্ষমতার ওপর চরম আঘাত হানেন।
জনসনের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা ওই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সুনাককে ক্ষমা করেননি। বরিস জনসনের কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যখন লিজ ট্রাস সুনাকের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন তাঁরা সবাই লিজকেই সমর্থন দেন। কিন্তু ক্ষমতায় বসার মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগে বাধ্য হন লিজ। ফলে সুনাকের জন্য আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। গত বছরের ২৫ অক্টোবর তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন এবং লিজ বিরোধী অবস্থান নেন।
ঋষি সুনাক ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক নমনীয় অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। জনসন ও ট্রাসের কাছাকাছি থাকা রক্ষণশীলদের থেকে দূরে সরে আসেন। রক্ষণশীল ডানপন্থীদের মতে, ঋষি সুনাক নীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
এ কারণেই কনজারভেটিভ পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দুর্বল হয়ে পড়েছেন ঋষি। এই সপ্তাহে দুটি বিষয় ঘটেছে, যা কিছু রক্ষণশীলদের মনে করিয়ে দেয়, কত দ্রুত সবকিছু ঘুরে যেতে পারে।
প্রথমটি হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যানের সঙ্গে কী করা হবে, তার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঋষি। সুয়েলা স্বীকার করেন, গাড়িতে গতিসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে জরিমানা গোনার হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। সুনাক সিদ্ধান্ত দেন, সুয়েলার কার্যকলাপ মন্ত্রিসভার কোড ভাঙেনি। অথচ আইন ভাঙার অপরাধে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হতো। সুনাক দ্রুত তাঁকে সুরক্ষা দিয়েছেন। কারণ, সুনাক জানেন তিনি সুয়েলার কাছে দুর্বল। সুয়েলার সঙ্গে তিনি লড়াইয়ে পারবেন না। তাঁকে পছন্দ করেন না এমন অনেকেই সুয়েলার সঙ্গে রয়েছেন।
এর আগে গত সপ্তাহে লন্ডনে সুনাকবিরোধী এক সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছিলেন ব্রেভারম্যান। ভবিষ্যতে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে আসতে চান তিনি। তাই সুনাকের কথার তোয়াক্কা না করেই ওই প্ল্যাটফর্মে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন সুয়েলা ব্রেভারম্যান।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আবার বরিস জনসনের আলোচনায় ফিরে আসা। করোনার সময় বরিস জনসন নিয়ম ভেঙেছিলেন বলে যে তথ্য সামনে এসেছে, পুলিশের প্রতিবেদনে বিষয়টি তার চেয়ে বেশি গুরুতর। পুলিশ বলছে, যতটুকু বিষয় সামনে এসেছে, জনসন তার চেয়ে আরও বেশি আইন ভঙ্গ করেছেন। বরিসের মিত্ররা বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি। তাঁরা এ জন্য সুনাককেই দুষছেন। তাঁদের অভিযোগ, সবকিছুর পেছনে তিনিই রয়েছেন। তবে ঋষি সুনাকের মুখপাত্র এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ঠিক এভাবেই দুজন ব্যক্তি সুনাকের জীবনকে খুব কঠিন করে তুলতে পারেন। তাঁরা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির ইতিবাচক শিরোনাম থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে পারেন, কনজারভেটিভ পার্টি কত দ্রুত নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।
ঋষি সুনাকের কিছু মিত্র ব্রেভারম্যানকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনায় সুনাকের সমালোচনা করেন। একবার মন্ত্রিত্বের কোড লঙ্ঘনের জন্য তাঁকে ট্রাসের সরকার থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সবাই জানে। পরবর্তী নির্বাচন আসার আগে নেতৃত্বের যেকোনো শীর্ষ পদে আসতে সবার আগে যিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়বেন, তিনি ব্রেভারম্যান। কনজারভেটিভ পার্টি যদি ক্ষমতা হারায়, তবে সে পরিস্থিতিও আসতে পারে।
কনজারভেটিভ পার্টির একজন জ্যেষ্ঠ পার্লামেন্ট সদস্য সিএনএনকে বলেন, ঋষি সুনাক ক্ষমতায় এসেছেন, তিনি দুর্বল তা জেনেই। বরিস জনসন ও লিজের মতো ততটা শক্তিশালী তিনি নন, সেটাও তিনি জানেন।
ওই সদস্য আরও বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, সুনাকের মতো খুব দুর্বল লোক ইতিমধ্যে দলের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে। তিনি বরিস বা লিজের ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের মতো করে একটা সরকার গড়তে পারবেন। কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দীর্ঘ মেয়াদে তাঁদের আরও শক্তিশালী করেছে।
কনজারভেটিভ পার্টির একজন সাবেক পরামর্শক বলেন, যদি জরিপে উন্নতি না হয়, তবে সুনাকের ঝুঁকি বাড়তে পারে। পার্লামেন্ট সদস্যরা যদি ভাবতে শুরু করেন, পরবর্তী নির্বাচনে জেতা যাবে না, তবে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন। দল এত দিন ধরে যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে, তা ভেঙে পড়বে।
কোনো দল ক্ষমতায় যেতে চাইলে দলে ঐক্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে কনজারভেটিভ পার্টিতে ঐক্য অনেক বেশি। তবে পার্টির একজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শক বলেন, ‘নরকে কোনো আশা থাকে না।’ পরবর্তী নির্বাচনে যাওয়ার আগে অতীতের মতো ঐক্য দেখানো ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচনী ওই পরামর্শক বলেন, ‘আমরা শীর্ষ পদ থেকে কাউকে নেতৃত্বের জন্য বেছে নিই। কিন্তু ব্রেভারম্যানের মতো কেউ যদি ইতিমধ্যে পরবর্তী নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কথা ভাবতে শুরু করেন, তবে পরের নির্বাচনে যা হতে যাচ্ছে, তা বাজে উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে।’
ঋষি সুনাক ক্ষমতায় এসেছিলেন সরকারে আরও বেশি পেশাদার পদ্ধতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। যুক্তরাজ্যে আগের তিন বছরে যা দেখা যায়নি। তাঁর ধীর ও অবিচল ব্যবস্থাপনাশৈলী ভোট বাড়াতে পারে। এই মুহূর্তে কেউ তাঁকে পদ থেকে সরানোর চেষ্টাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে না।
আবার যুক্তরাজ্যে রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আসবে বা বরিস জনসন আবার ক্ষমতায় ফিরছেন—এমন কথাও কেউ ভাবছে না। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ঋষি সুনাক দায়িত্বে থাকুন, তা অনেকের চাওয়া। তাঁর হাত ধরে অর্থনীতি চাঙা হোক, এটাও চাইছে অনেকে। তবে ভয় হচ্ছে, কনজারভেটিভ পার্টির কদর্য রূপ সামনে আসতে শুরু করবে। এতে দলাদলি ফিরে আসবে এবং এর ফলে নির্বাচনী পরাজয়ও হতে পারে তাদের।
এ সপ্তাহে কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা এসব কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। একজন পার্লামেন্ট সদস্য বলেছেন, আধুনিক কনজারভেটিভ পার্টি পতন থেকে তিন ধাপ দূরে রয়েছে।