বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র: পুতিন কী চাইছেন, যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবছে

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সামরিক যান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মিত্র দেশ বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর এ ঘোষণা মোটেও ভালোভাবে নেয়নি ইউক্রেন। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, পুতিনের এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বেলারুশকে ‘পারমাণবিক জিম্মি’ বানিয়েছে মস্কো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য, বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নয়।

রাশিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে গতকাল শনিবার দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই ঘোষণা দেন পুতিন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তাকারী ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে হুঁশিয়ার করলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। একই সঙ্গে যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমাদের সঙ্গে মস্কোর দ্বন্দ্বের আগুনে আরও ঘি ঢাললেন তিনি।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর একাধিকবার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে হুমকি দিয়েছেন পুতিন। তাঁর এবারের ঘোষণাও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। আর পুতিন বলছেন, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র কমাতে রাশিয়ার যে প্রতিশ্রুতি, তা লঙ্ঘন হবে না।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র হাতে রয়েছে রাশিয়ার। এরপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পুতিনের শনিবারের ঘোষণা এবং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন।

এদিকে পুতিনের ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইউক্রেনের কর্তাব্যক্তিরা। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের প্রধান ওলেকসি দানিলভ টুইটারে লিখেছেন, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া রাশিয়া ও পুতিনকে নিয়ে বেলারুশে সামাজিক পর্যায়ে ‘নেতিবাচক ধারণা’ বাড়বে, ‘মানুষের প্রত্যাখ্যানের’ মুখে পড়তে হবে। ক্রেমলিন বেলারুশকে ‘পারমাণবিক জিম্মি’ বানিয়েছে।

বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণার সময় যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনেছেন পুতিন। বলেছেন, মার্কিন সরকারও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একই অস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে। তবে বেলারুশে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা হলেও এর নিয়ন্ত্রণ দেশটির হাতে দেওয়া হবে না।

রাশিয়া যদি শেষ পর্যন্ত বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করে, তাহলে তা হবে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে রাশিয়ার বাইরে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়নের প্রথম ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়া দেশের বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেনি বলে এত দিন বড়াই করে এসেছে মস্কো।

বেলারুশ ও রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশের সঙ্গেই সীমান্ত রয়েছে বেলারুশের। গত বছর ইউক্রেনে রুশ সেনা পাঠাতে নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিয়েছিল দেশটি। দুই দেশ যৌথ সামরিক মহড়াও চালিয়েছে।

পুতিনের ঘোষণা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াকও। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন নিয়ে বক্তব্য দিয়ে পুতিন স্বীকার করেছেন যে তিনি পরাজিত হওয়ার ভয়ে রয়েছেন। আর তিনি সর্বোচ্চ যেটা করতে পারেন তা হলো, এভাবে কৌশলে ভয় দেখানো।’

উদ্বিগ্ন নয় যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র হাতে রয়েছে রাশিয়ার। এরপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পুতিনের শনিবারের ঘোষণা এবং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন।

এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো নিয়ে আমাদের অবস্থান নতুন করে সাজানোর কোনো কারণ দেখছি না। আর রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই। ন্যাটো জোটের সমন্বিত প্রতিরক্ষায় বিষয়ে আমরা এখনো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের একটি সংজ্ঞা আছে। এসব অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো সাফল্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হয়। কোনো শহর পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া সক্ষমতা নেই এগুলোর। রাশিয়ার হাতে এই পারমাণবিক অস্ত্র কী পরিমাণ আছে, তা পরিষ্কার নয়।

সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে বেলারুশ যাচ্ছেন রুশ সেনারা

বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো বহু আগে থেকে তাঁর দেশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে রাশিয়ার কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন পুতিন। তবে রুশ প্রেসিডেন্টের এ দাবি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি লুকাশেঙ্কো।

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভুল-বোঝাবুঝি ও ভুল হিসাব-নিকাশের সম্ভাবনা খুবই বেশি। পারমাণবিক অস্ত্র আরেক দেশে মোতায়েন করা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। একই সঙ্গে মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি ডেকে আনবে
ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস

বেলারুশ ও রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশের সঙ্গেই সীমান্ত রয়েছে বেলারুশের। গত বছর ইউক্রেনে রুশ সেনা পাঠাতে নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিয়েছিল দেশটি। দুই দেশ যৌথ সামরিক মহড়াও চালিয়েছে। তবে বেলারুশের সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দেয়নি।

পুতিনের ঘোষণার পর পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা ‘এখনো অনেক কম’ বলে উল্লেখ করেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি অব ওয়্যারের (আইএসডব্লিউ) বিশ্লেষকেরা। আইএসডব্লিউ জানিয়েছে, তারা এখনো পুতিনকে ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক—এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখছে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের একের পর এক হুমকি দিয়ে গেলেও, এ ধরনের হামলা চালানোর কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই।

তবে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে জাতিসংঘের একটি চুক্তির সমর্থনে কাজ করা জোট ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস বলছে ভিন্ন কথা। এক টুইট বার্তায় তারা বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভুল–বোঝাবুঝি ও ভুল হিসাব–নিকাশের সম্ভাবনা খুবই বেশি। পারমাণবিক অস্ত্র আরেক দেশে মোতায়েন করা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। একই সঙ্গে মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি ডেকে আনবে।

নতুন ‘অক্ষ’ গড়ছে পশ্চিমারা

চীনের সঙ্গে রাশিয়া কোনো সামরিক জোট গড়ছে না বলে আজ রোববার জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। পাল্টা অভিযোগ করে তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও জাপান যে ধরনের অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছিল, একই ধরনের একটি ‘অক্ষ’ গড়ার চেষ্টা করছে পশ্চিমারা।

পুতিন বলেন, ‘এ কারণেই পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত শতকের ত্রিশের দশকে ফ্যাসিস্ট জার্মানি, ইতালি ও জাপান মিলে যেমন অক্ষ গড়ে তুলেছিল, তেমনই একটি অক্ষ গড়া শুরু করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।’ ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে শুরু থেকেই অবশ্য এই সুরে কথা বলে আসছে মস্কো। তাদের ভাষ্য ছিল, কথিত নাৎসিদের খপ্পর থেকে ইউক্রেনকে রক্ষা করতেই যুদ্ধে জড়িয়েছে রাশিয়া।