ব্রিটিশ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাইক লিঞ্চ
ব্রিটিশ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাইক লিঞ্চ

সিসিলিতে প্রমোদতরিডুবিতে নিখোঁজ কে এই ব্রিটিশ ধনকুবের

ইতালির দ্বীপ সিসিলির উপকূলে গত সোমবার একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরি (ইয়ট) ডুবে যাওয়ার ঘটনায় ব্রিটিশ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাইক লিঞ্চ ও তাঁর মেয়ে হান্না লিঞ্চ নিখোঁজ হন।

১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অটোনমির সহপ্রতিষ্ঠাতা মাইক। পরে তিনি আরও কয়েকটি সফল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা করেন।

কেউ কেউ এই ধনকুবেরকে যুক্তরাজ্যের ‘বিল গেটস’ বলে থাকেন। মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি।

খারাপ আবহাওয়ার কারণে বায়েসিয়ান নামের ৫৬ মিটার দৈর্ঘ্যের সুপার ইয়টটি ডুবে যাওয়ার পর একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো ছয়জন নিখোঁজ রয়েছেন। সুপার ইয়টটির মালিকানার সঙ্গে মাইক পরিবারের সংশ্লিষ্টতা আছে।

মাইকের স্ত্রী অ্যাঞ্জেলা বেকারেসকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

ব্রিটিশ প্রযুক্তি মোগল মাইক ২০১১ সালে মার্কিন কম্পিউটিং জায়ান্ট এইচপির কাছে তাঁর কোম্পানি অটোনমি ১১ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে তাঁর সম্পদ বাড়ান।

কোম্পানি বিক্রিকে কেন্দ্র করে একটি আইনি লড়াই শুরু হয়, যা এক দশকের বেশি সময় ধরে চলে।

কোম্পানি বিক্রির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে হওয়া একাধিক জালিয়াতির মামলা থেকে গত জুনে খালাস পান মাইক। দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি দুই দশকের বেশি মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতেন।

চলতি আগস্টে বিবিসি রেডিও ফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইক বলেছিলেন, তাঁর বিশ্বাস, তিনি শুধু তাঁর ধনসম্পদের কারণেই মার্কিন আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

ইয়ট ডুবে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটে সেদিনই, যেদিন তাঁর সঙ্গে মামলায় আসামি হওয়া স্টিফেন চেম্বারলিনের মৃত্যুর খবর আসে। তিনি গত শনিবার যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজশায়ারে জগিং করার সময় গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়েছিলেন। তাঁর আইনজীবী এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

কেমব্রিজ ও অটোনমি

মাইকের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৬ জুন। তাঁর মা নার্স ছিলেন, বাবা ফায়ার সার্ভিসের সদস্য। এসেক্সের চেমসফোর্ডের কাছে বেড়ে উঠেছেন মাইক।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পড়ালেখা করেন মাইক। এখানেই তিনি গাণিতিক কম্পিউটিংয়ে পিএইচডি করেন। পরে তিনি একটি গবেষণা ফেলোশিপ সম্পন্ন করেন।

১৯৯১ সালে মাইক কেমব্রিজ নিউরোডাইনামিকস নামের একটি ফার্ম প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটির কাজের ক্ষেত্র ছিল কম্পিউটারভিত্তিক শনাক্তকরণ।

পাঁচ বছর পর মাইক তাঁর প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অটোনমি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটির সফটওয়্যারের ভিত্তিমূলে রাখা হয় ‘বায়েসিয়ান ইনফারেন্স’ নামের পরিচিত একটি পরিসংখ্যান পদ্ধতি।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এবং চলতি শতকের শুরুর দিকে কোম্পানিটির দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটে। আসে সাফল্য। এই সুবাদে মাইক অনেক পুরস্কারের পাশাপাশি প্রশংসা কুড়ান।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে মাইক ব্রিটিশ সরকারের সম্মানজনক অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) উপাধি পান।

মাইক একজন নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে বিবিসির বোর্ডে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাউন্সিলে যোগ দেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে তিনি এআই উন্নয়নের ঝুঁকি ও সম্ভাবনা বিষয়ে পরামর্শ দেন।

২০১১ সালে এইচপির কাছে অটোনমি বিক্রি করে মাইক ভালোই লাভবান হন বলে ধারণা করা হয়। পরে তিনি প্রযুক্তি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভোক ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন।

২০১৩ সালে ব্রিটিশ সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি ডার্কট্রেস প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করে।

মাইক এই ফার্মের একজন শেয়ারহোল্ডার। চলতি বছরের শুরু পর্যন্ত তিনি এই ফার্মের বোর্ডে ছিলেন।

বন্ধু ও পরিবার

মাইক ও তাঁর স্ত্রী অ্যাঞ্জেলার দুই মেয়ে রয়েছে। তাঁদের বসবাসস্থল যুক্তরাজ্যের সাফোকের লাউডহাম হল এস্টেট।

মাইকের ১৮ বছর বয়সী মেয়ে হান্না ডুবে যাওয়া ইয়টে ছিলেন।

সিসিলির নাগরিক সুরক্ষা সংস্থার মহাপরিচালক সালভাতর কোসিনা বিবিসিকে বলেছেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে মাইক, তাঁর মেয়ে হান্না ও ইয়টের এক শেফ রয়েছেন।

বিবিসি ভেরিফাই করপোরেট রেকর্ড খতিয়ে দেখেছে, ডুবে যাওয়া ইয়টের মালিকানার সঙ্গে মাইক পরিবারের সংশ্লিষ্টতা আছে।

ঘটনা সম্পর্ক অবগত সূত্র বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে, মাইকের স্ত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

অটোনমি-সংক্রান্ত মামলার বিচারে মাইকের সঙ্গে আসামি হওয়া স্টিফেন একটি গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছেন। তিনি গত শনিবার গাড়ির ধাক্কায় মারা যান।

এইচপির কাছে কোম্পানি বিক্রি

ফোনকল, ই-মেইল, ভিডিওর মতো ডেটা থেকে দরকারি তথ্য বের করার সফটওয়্যার তৈরিতে অটোনমি সফল হয়।

২০১১ সালে এইচপির কাছে অটোনমি বিক্রির আগে প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর ছিল সান ফ্রান্সিসকো ও কেমব্রিজে।

কিন্তু কোম্পানিটি বিক্রির পর ‘প্রাইস ট্যাগ’ নিয়ে যাচাই-বাছাই শুরু হয়।

২০১৮ সালে মার্কিন প্রসিকিউটররা মাইকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। কৃত্রিমভাবে কোম্পানির মূল্য বেশি দেখানোর অভিযোগে তাঁকে অভিযুক্ত করেন তাঁরা।

প্রসিকিউটররা মাইকের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ আনেন।

মাইক চলতি আগস্টের শুরুতে বিবিসি রেডিও ফোরকে বলেছিলেন, দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া চলাকালে নিশ্চিত ছিলেন, তিনি নির্দোষ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর মনে হয়েছে, তিনি কেবল তাঁর সম্পদের কারণেই মার্কিন আদালতে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন।

মাইক উল্লেখ করেছিলেন, একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে নিজেকে রক্ষার জন্য কারও অর্থ থাকার দরকার নেই।

মাইক বলেছিলেন, তিনি নির্দোষ বলে যে আজ এখানে (সাক্ষাৎকার) বসে আছেন, বিষয়টি এমন নয়। সত্য হলো, তিনি যথেষ্ট অর্থের মালিক বলেই এখানে আছেন।

মাইক আরও বলেছিলেন, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর তিনি চেয়েছিলেন, নিজের পছন্দসই কাজে ফিরতে। আর তা উদ্ভাবনী কাজ।