তুরস্কের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার শহর কোবানের বাসিন্দা ছিলেন নিরোজ হোসেইন। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে নিষিদ্ধ ঘোষিত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) সেখানে হামলা চালায়। এতে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে তাঁর পরিবার। এখন তাঁর আবাস তুরস্ক। তিনি চাইছেন, তুরস্কের এবারের নির্বাচনে যেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আবার জয়ী হন।
রোদে কাপড় শুকাতে দিতে দিতে এই ইচ্ছার কথা জানালেন চার সন্তানের মা নিরোজ। তাঁর এই ইচ্ছার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। বললেন, ‘এরদোয়ান আমাদের এখানে (তুরস্কে) থেকে যেতে সাহায্য করবেন।’
১৪ মে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে। বিগত ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ান এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছেন। কারণ, দেশটির বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) চেয়ারম্যান কেমাল কিলিচদারোগ্লুর সঙ্গে তাঁর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে।
২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর সিরিয়ার প্রায় ৩৭ লাখ মতান্তরে ৫০ লাখ নাগরিক তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে থাকার জন্য তাঁদের ‘অস্থায়ী সুরক্ষা’ দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো তুরস্কের সরকার চাইলে তাঁদের এই দেশ থেকে বের করে দিতে পারবে। আর এখানেই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ, সিএইচপি নেতা কেমাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি জয়ী হলে দুই বছরের মধ্যে এই শরণার্থীদের সিরিয়ায় ফেরত পাঠাবেন। ফলে নিরোজের মতো অনেক সিরীয় শরণার্থী চাইছেন, ১৪ মের নির্বাচনে এরদোয়ানই জিতুক।
নিরোজ বলেন, তাঁর বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ পর আইএস কোবানে হামলা চালায়। এই হামলার পর সিরিয়ার সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার ভেতরে তুরস্কের সানলিউরফা শহরে চলে আসেন তাঁরা। এখন এই শহর তাঁদের দ্বিতীয় আবাস।
নিরোজের স্বামী আদিল শেহো। তিনি বলেন, ‘আমাদের চার সন্তানের জন্ম এই শহরে। সিরিয়া সম্পর্কে তারা জানেন না।’ তিনি বলেন, ‘যখন এখানে আসি, তখন সবাই খুব ভালোভাবেই আমাদের গ্রহণ করেছিল। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা দেখা দিলে ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে।’
তুরস্কে এবার বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৮৫ শতাংশে পৌঁছেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। আদিল বলেন, এসব কারণে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে তুরস্কের নাগরিকদের মধ্যে। সানলিউরফা শহরের পরিস্থিতি তুলে ধরে আদিল বলেন, ‘যদি তাঁরা ফেরত না–ও পাঠায়, তারপরও আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। তাঁরা আমাদের কাছে নথিপত্র চাইবে, আমাদের বাসাভাড়া, পরিষেবা বিল বাড়াবে।’
এই পরিষেবা বিল যে বাড়তে পারে, সেই নমুনা ইতিমধ্যেই দেখেছেন সিরিয়ার শরণার্থীরা। ২০২১ সালেই বালু শহরে সিএইচপি পার্টির মেয়র শরণার্থীদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা বা সেবা কর্মসূচি বাতিল করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সিরিয়ার শরণার্থীদের পানির বিল একধাপে ১১ গুণ বাড়িয়েছেন। এ ছাড়া এই শহরে শরণার্থীদের বিয়ের নিবন্ধনসংক্রান্ত কর দ্বিগুণ করেছেন। মেয়রের এই কার্যক্রমে দলের স্বীকৃতি ছিল না। ফলে তাঁকে মাশুল গুনতে হয়েছে। কিন্তু যে পরিবর্তন বালু শহরের মেয়র এনেছিলেন, সেই পরিবর্তনের বাতাস পুরো তুরস্কে বইছে। অর্থাৎ মোটামুটি সব শহরে শরণার্থীদের জীবনযাপন কঠিন হয়েছে।
শরণার্থীর সংখ্যা হিসাবে নিলে সবচেয়ে বেশি শরণার্থীর দেশ তুরস্ক। সীমান্ত পেরিয়ে আসা সিরীয়দের কারণেই এটা হয়েছে। তবে দেশটিতে গিয়ে সিরীয়রা বেশ কিছু সুবিধাও পেয়েছেন; যেমন যাঁরা বিনিয়োগ করতে পেরেছেন কিংবা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা তুরস্কের নাগরিক হতে পেরেছেন। এমন সুযোগ নিয়েছেন ২ লাখ ৪০ হাজার শরণার্থী। তাঁদের অনেকে এবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এমনই একজন হোসেইন উৎবাহ। তুরস্কে তড়িৎ কৌশলে পড়ছেন তিনি।
হোসেইনের বয়স ২৭ বছর। পরিবারের মধ্যে তিনি একমাত্র ভোটাধিকার পেয়েছেন। জানালেন, এবার এরদোয়ানকে ভোট দেবেন তিনি। তিনিও চান, এরদোয়ান জয়ী হোন। বলেন, ‘আমি ও আমার বন্ধুরা সবাই এরদোয়ানের জয় চাই। এটা শুধু এ জন্য নয়, আমরা সিরীয়। এরদোয়ান দেশের জন্য যা করেছেন, সে জন্যই চাই তিনি জয়লাভ করুন।’
হোসেইনের পরিবার ২০১৫ সালে রাক্কা থেকে পালিয়ে তুরস্কে এসেছে। ওই বছর আইএস রাক্কাকে রাজধানী করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল। সিএইচপির ঘোষণা অনুসারে, সিরীয়দের স্বেচ্ছা ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন হবে। তবে দলটির এই চাওয়াকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছেন হোসেইন। তিনি বলেন, ‘আমরা সিরিয়ায় ফেরত যেতে পারব না এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে বিশ্বাস করতে পারব না।’
সিরিয়ার নাগরিক জারা দোগবেহের বয়স ৫০ বছর। ২০১৮ সাল থেকে তুরস্কে খাবারের ক্যাটারিং চালান তিনি। ২০১৮ সালের তুরস্কের নির্বাচন তিনি দেখেছেন। ওই নির্বাচনে এরদোয়ান জিতেছিলেন। তিনি বলেন, এবারের পরিস্থিতি বেশি ভয়ের। কারণ, সিএইচপির নেতারা তাঁদের প্রতিটি বক্তব্যে বলছেন, সিরীয়দের ফেরত পাঠানো হবে। সিএইচপি তাঁদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জারা বলেন, ‘তুরস্কের যাঁরা আমাদের প্রতিবেশী, তাঁরা আমাদের নিয়ে চিন্তিত।’
তবে স্থানীয় সিএইচপি নেতা হালিল বারুত অবশ্য ভিন্ন কথা বললেন। তাঁর মতে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাঁদের (সিরীয়দের) নিরাপত্তা। তাঁরা আমাদের ভাই। আমরা তাঁদের আগুনের মধ্যে ঠেলে দিতে পারি না। আমরা তাঁদের যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিতে পারি না।’
তবে শরণার্থীরা যে তুরস্কের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ঠিকই মনে করিয়ে দিলেন হালিল। তিনি বলেন, ‘তাঁরা (সিরীয়রা) আসার কারণে বাড়িঘরের দাম বেড়েছে, বাসাভাড়া বেড়েছে। এ কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
সিরীয়রা আসার কারণে তুরস্ক যে লাভবান হয়নি, এমন নয়। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও টেক্সটাইল খাতে কম দামে এখন শ্রমিক পাচ্ছে তুরস্ক। এ নিয়ে কথা হয় তুরস্কের চিন্তক প্রতিষ্ঠান টিইপিএভির গবেষক ওমর কাদকয়ের সঙ্গে। তাঁর মতে, গণহারে সিরীয়দের প্রত্যাবাসন হবে বাস্তবতাবর্জিত পদক্ষেপ।
ওমর কাদকয় বলেন, ‘সিরিয়ার যুদ্ধ থেমে গেলেও আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, তাঁরা (সিরীয়রা) সেখানে নিরাপদ থাকবেন। কারণ, সিরিয়ায় গুম, নিপীড়ন ও অপহরণের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।’ তাঁর মতে, অর্থনীতি, ন্যায় বিচার ও গণতন্ত্রের কথা না ভেবে সিএইচপি প্রত্যাবাসনকে ভোটের ইস্যু বানিয়েছে।
আবারও জারা দোগবেহের কথায় ফেরা যাক। তাঁর ক্যাটারিং ব্যবসায় ছেলে মোহাম্মদ উৎবাহ খাবার ডেলিভারির কাজ করেন। ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ খানিকটা অবাক সিএইচপির বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে খারাপ বা ভুল কিছু করছি না। আমরা তো তাঁদের তুরস্কের উপকারই করছি।’