রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিশাল জলাধারের বাঁধ ধ্বংস করা হয়েছে। এতে আশপাশের বড় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাঁধটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেছে ইউক্রেন ও দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা। এ ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধও বলছে তারা। তবে রাশিয়া বলছে, পাল্টা হামলার ব্যর্থতা আড়াল করতে ইউক্রেন নাশকতা চালিয়ে বাঁধটি ধ্বংস করেছে। এ ঘটনায় জলাধারের আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের অন্যত্র আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই বন্যা সর্বনাশা রূপ নিতে পারে।
কাখোভকা জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটি ইউক্রেনের খেরসন অঞ্চলের নোভা কাখোভকা শহরে অবস্থিত। এ অঞ্চল বর্তমানে রাশিয়ার দখলে রয়েছে। সোভিয়েত আমলে এটি তৈরি করা হয়। নিপ্রো নদীর পাশ ঘেঁষে যে ছয়টি জলাধার তৈরি করা হয়, এটি সেগুলোর একটি। নিপ্রো নদী এতই বিশাল যে ইউক্রেনের উত্তর থেকে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।
স্থানীয় লোকজন এ জলাধারকে কাখোভকা সমুদ্র নামে ডাকে। অনেক জায়গায় এটির এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। রয়টার্সের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের গ্রেট সল্ট লেকে যে পরিমাণ পানি আছে, এ জলাধারে সেই পরিমাণ রয়েছে।
স্থিরচিত্র ও ভিডিওতে দেখা গেছে, জলাধারের বাঁধের একটি অংশ ধসে পড়েছে। সেখান দিয়ে প্রবল বেগে পানি ভাটার দিকে চলে যাচ্ছে।
জলাধারটি ঠিক কখন প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্যাটেলাইটে ধরা পড়া আলোকচিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কয়েক দিন ধরে জলাধারের অবস্থার অবনতি হয়েছে।
জলাধারটির ওপর দিয়ে যাওয়া একটি সড়ক ২ জুন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় দেখা যায়। তবে এতে মঙ্গলবার (৬ জুন) ওই সড়কের (বাঁধ) অংশবিশেষ ও কাছের ভবনগুলো ধসে পড়ার আগপর্যন্ত পানিপ্রবাহে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। আজ বাঁধের একটি অংশ ধসে পড়ার সঙ্গে সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
বাঁধ ভেঙে পানি কতটা এলাকায় বিস্তৃত হতে পারে, তা স্পষ্ট না হলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে এতে ১৬ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নোভা কাখোভকা শহর থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, ভবনগুলোর চারপাশে বন্যার পানি। এমনকি স্থানীয় সরকারি দপ্তরের চারপাশে রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে।
জলাধারের ৫০ মাইলের কম দূরত্বে খেরসন শহর। সেখানে নিচু এলাকার বাসিন্দাদের যত দ্রুত সম্ভব উঁচু স্থানে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।
খেরসন অঞ্চলের প্রধান ওলেক্সান্দর প্রোকুদিন ইউক্রেনের টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেন, আজ সকালে আটটি গ্রাম বন্যার পানিতে পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। আরও এলাকা প্লাবিত হবে।
ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য, স্টেশনটি ‘পুরোপুরি ধ্বংস’ হয়ে গেছে। এটি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
বাঁধটি কেন ধসে পড়েছে, এটি এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, রাশিয়া এটি উড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তিসংগত কারণ এটি হতে পারে যে মস্কোর আশঙ্কা ছিল পাল্টা আক্রমণের অংশ হিসেবে ইউক্রেন বাঁধের ওপরের সড়ক ব্যবহার করে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে তাদের (রুশ বাহিনী) ওপর হামলা চালাতে পারে।
কিন্তু ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এ ঘটনায় রাশিয়ার সম্পৃক্ততার অভিযোগ নাকচ করেছেন; বরং উল্টো ইউক্রেনকেই দায়ী করেন তিনি। তাঁদের ভাষ্য, ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে পানি থেকে বঞ্চিত করতে এই ‘নাশকতা’ চালিয়েছে ইউক্রেন। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজেদের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
বেশ কয়েকটি কারণেই এ জলাধার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা বিপুল পরিমাণ পানি ধরে রাখে, যা থেকে উজানে থাকা লোকজন উপকৃত হন। কৃষকেরা তাঁদের ফসল ফলাতে এই পানির ওপর নির্ভরশীল। এখন এই পানি অনেক কমে গেলে হাজারো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
প্রায় ১০০ মাইল উজানে থাকা জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে শীতল রাখতেও এই জলাধারের পানি ব্যবহার করা হয়। এটি এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলছে, তাৎক্ষণিকভাবে তারা পারমাণবিক নিরাপত্তাঝুঁকি দেখছে না। তবে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
পরে আইএইএ এক বিবৃতিতে জানায়, জলাধারের পানির উচ্চতা ১২ দশমিক ৭ মিটারের নিচে নেমে গেলেও সেখান থেকে পাম্পের মাধ্যমে জাপোরিঝঝিয়ায় পানি সরবরাহ করা যাবে। তা ছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঠান্ডা রাখতে পাশেই একটি বড় পুকুরসহ (কুলিং পন্ড) বিকল্প উৎস রয়েছে।
তবে নিপ্রো থেকে ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া নিজেদের দখলে নেওয়ার পর ইউক্রেন নোভা কাখোভকা থেকে পানি যাওয়ার চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়। এতে সেখানে পানিসংকট দেখা দেয়। তবে গত বছর পুরোদমে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর রুশ বাহিনী চ্যানেলটি খুলে দেয়। কিন্তু বাঁধ না থাকলে জলাধারের পানির স্তর কমে গিয়ে আবারও ক্রিমিয়া বিপদে পড়তে পারে।