রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলো ও রাশিয়া—দুই পক্ষের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলছে ভারত। যুদ্ধ শুরুর পরই দ্রুত ইউক্রেনে মানবিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে নয়াদিল্লি। আবার যুদ্ধের ৯ মাস গড়ালেও এখনো রাশিয়ার অভিযানের নিন্দা জানায়নি তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই পক্ষের সঙ্গেই যেহেতু ভারতের সম্পর্ক ভালো, তাই চলমান যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে দেশটি।
রাশিয়ার অভিযানের নিন্দা না জানানোর পেছনে একটি কারণ দেখিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছিলেন, এটা করা হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষার বিষয়গুলো মাথায় রেখে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও চলতি মাসে বলেছেন, ‘অন্যদের’ চাহিদা মেটানোর কথা মোটেও ভাবছেন না তিনি। এখানে অন্যদের বলতে পশ্চিমা দেশগুলোকে বুঝিয়েছেন জয়শঙ্কর।
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ও অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে রাশিয়া। ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারতে আমদানি করা অস্ত্রের ৬০ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। আর রাশিয়া থেকে চলতি বছরের অক্টোবরে ভারতের মোট চাহিদার ২২ শতাংশ জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে।
তবে যুদ্ধ যতই জোরদার হয়েছে, বিশ্বজুড়ে বেড়েছে জ্বালানি ও খাদ্যের সংকট। ফলে রাশিয়া নিয়ে নিজেদের অবস্থান নতুন করে ভাবতে হচ্ছে দিল্লিকে। গত সেপ্টেম্বরে উজবেকিস্তানে সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে মোদি বলেছিলেন, ‘আমি জানি বর্তমান সময়টা যুদ্ধের নয়। এটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে।’ সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত বড় অর্থনীতির ২০টি দেশের জোট জি-২০ সম্মেলনে মোদি বলেন, ‘আমাদের ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর একটা পথ খুঁজতে হবে।’
রাশিয়া নিয়ে ভারত অবস্থান পরিবর্তনের দিকে রয়েছে বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) গবেষক বিবেক মিশ্র। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা ১০ মাস ধরে দেখেছি, যুদ্ধ থামানোয় মধ্যস্থতা করতে ভারতের আগ্রহ বেড়েছে। এটা আরও পরিষ্কার হয়েছে ভারতের এটা বলার মধ্য দিয়ে যে এই সময়টা যুদ্ধের নয়। আগামী বছরে দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে যুদ্ধে মধ্যস্থতা করতে ভারতের ভূমিকা আরও জোরদার হতে পারে।’
যুদ্ধ থামাতে ভারতের উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়েছে রাশিয়া। উজবেকিস্তানে এসসিও সম্মেলনে মোদিকে আশ্বাস দিয়ে পুতিন বলেছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ থামাতে সবকিছু করবেন তিনি। তবে একই সঙ্গে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার জন্য ইউক্রেনকে দোষারোপ করেছিলেন পুতিন।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় অনেকটা কোণঠাসা মস্কো। এমন পরিস্থিতিতে দিল্লির সঙ্গে বাণিজ্য বাড়িয়ে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছেন পুতিন। এসসিও সম্মেলনে মোদিকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ছে। ভারতের বাজারগুলোতে রাশিয়ার সার পৌঁছে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এটা আগের তুলনায় আট গুণ বেড়েছে। আশা করি, এটা ভারতের কৃষি খাতকে বড় সহায়তা করবে।’
উজবেকিস্তানে সম্মেলনের আগে ভারতে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ডেনিস আলিপভও দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি রুশ বার্তা সংস্থা তাসকে বলেছিলেন, ‘২০২২ সালের প্রথমার্ধে, দুই দেশের বাণিজ্যে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি দেখেছি আমরা। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য হয়েছে। যেখানে পুরো ২০২১ সালে বাণিজ্য হয়েছিল ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার।’
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ও অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে রাশিয়া। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারতে আমদানি করা অস্ত্রের ৬০ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। আর রাশিয়া থেকে চলতি বছরের অক্টোবরে ভারতের মোট চাহিদার ২২ শতাংশ জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক ভালো নয়। সে কারণে পশ্চিমারা চাইছে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। গত জুলাইয়ে দিল্লির সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। চলতি বছরে অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে ভারত। আগামী বছরে যুক্তরাজ্য ও কানাডার সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি করবে দেশটি।
ওআরএফের বিবেক মিশ্রর মতে, ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ভারতের নতুন অবস্থান রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির বাণিজ্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসবিষয়ক মন্ত্রী হরদ্বীপ সিংয়ের একটি বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করেন। সম্প্রতি হরদ্বীপ সিং বলেছেন, রাশিয়া থেকে তেল কিনতে ভারতের কোনো নৈতিক বাধা নেই। কারণ, একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে ভারতকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। আর বিশ্বে পণ্যের দাম যেন কম থাকে, সে কারণে তেল কিনতে হয়। তাই রাশিয়ার সঙ্গে এই বাণিজ্য চলবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক ভালো নয়। তাই পশ্চিমারা চাইছে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। গত জুলাইয়ে দিল্লির সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। চলতি বছরে অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে ভারত। আগামী বছরে যুক্তরাজ্য ও কানাডার সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি করবে দেশটি।
এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষাবিষয়ক অংশীদারত্ব বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষায় ভারতকে অন্যতম প্রধান একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। এর মধ্য দিয়েও দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তাসংক্রান্ত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
‘শান্তিপূর্ণভাবে যুদ্ধ শেষ করার এই প্রক্রিয়া যদি সামনের দিকে এগোয় আর ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে বসে, তাহলে রাশিয়াকেও আলোচনার জন্য রাজি করাতে ভারতকে আহ্বান করতে পারে পশ্চিমা দেশগুলো’বিবেক মিশ্র, গবেষক, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ)।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের গুরুত্ব বাড়াতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বড় ভূমিকা পালন করেছে। তবে তা মানতে নারাজ বিবেক মিশ্র। তাঁর মতে, ভারত বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নিজেদের অর্থনীতির কারণে। দেশটির অর্থনীতি যুক্তরাজ্যকে পেছনে ফেলেছে। বর্তমানে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আর এগুলো হয়েছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতকে আলাদাভাবে সবার নজরে আনতে সহায়তা করেছে বলে মনে করেন এই গবেষক। কারণ, ভারত একই সঙ্গে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মিত্র। বিবেক মিশ্র বলেন, ‘এই দিক দিয়ে দেখলে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত যে ভূমিকা পালন করছে, তার ক্ষেত্র বেড়েছে।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে শেষ হবে, তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও শান্তিপূর্ণভাবে এই যুদ্ধের ইতি টানতে নানা পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বেড়েছে। আগামী ডিসেম্বর থেকে জি-২০-এর নেতৃত্বে থাকবে ভারত। তাই যুদ্ধ থামানোয় বড় ভূমিকা রাখতে পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের কাছে তদবির করতে পারে বলে মনে করেন বিবেক মিশ্র।
বিবেক মিশ্রর ভাষ্যমতে, শান্তিপূর্ণভাবে যুদ্ধ শেষ করার এই প্রক্রিয়া যদি সামনের দিকে এগোয় আর ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে বসে, তাহলে রাশিয়াকেও আলোচনার জন্য রাজি করাতে ভারতকে আহ্বান করতে পারে পশ্চিমা দেশগুলো। কারণ, ভারত জি-২০-তে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে এবং মস্কোর সঙ্গে দেশটির বিশেষ একটি সম্পর্ক আছে।
বিবেক মিশ্র বলেন, পশ্চিমা ও রাশিয়া—দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি সেতু হিসেবে ভবিষ্যতেও কাজ করবে ভারত। দেশটির এই অবস্থান যুদ্ধ থামাতেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে।