ইউক্রেনে সেন্ট্রাল কিয়েভের একটি অফিসে ২৬ বছর বয়সী এক যোদ্ধা মুঠোফোনে ভিডিও দেখছেন। ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, এক তরুণীকে কেউ একজন আবেগঘন চুম্বন করছেন। এমন ভিডিও ওই যোদ্ধাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হচ্ছে না; বরং অন্যদের পাশে থেকেই তা দেখছেন। কেবল ওই যোদ্ধাই নন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত সাবেক যোদ্ধারাও এমন ভিডিও দেখতে পারছেন।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে আহত যোদ্ধা, যাঁরা স্বাভাবিক যৌনজীবনে ফিরতে পারছেন না, এবার তাঁদের সহায়তা দিতে উদ্যোগ নিয়েছে একটি দাতব্য সংস্থা। রিসেক্স নামের একটি সংস্থা এই উদ্যোগ নিয়েছে। কিয়েভের একটি অফিসে ২৬ বছর বয়সী ওই যোদ্ধা মূলত মুঠোফোনে রিসেক্সের একটি বিজ্ঞাপন দেখছিলেন।
গত বছরের মার্চে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বন্দর শহর মারিউপোলের নৃশংস হামলা চালায়। এতে শহরটির বেশির ভাগ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শহরটির প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন নৌবাহিনীর সদস্য হিলিব স্ট্রাইজকো। কিন্তু বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনি একটি ভবনের তৃতীয় তলা থেকে নিচে পড়ে যান। এরপর তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন।
হিলিবের নিম্নাঙ্গ (মেরুদণ্ডের নিচের অংশ ও নিতম্বের মধ্যকার অস্থিকাঠামো), চোয়াল ও নাক ভেঙে সংকুচিত হয়ে যায়। বিস্ফোরণের কারণে তীব্র গরমে তাঁর চোখে থাকা সামরিক চশমা গলে মুখে আটকে যায়। এ অবস্থায় তাঁকে আটক করে রুশ বাহিনী যুদ্ধবন্দী হিসেবে নিয়ে নেয়।
এ ঘটনার পরের মাসে হিলিবকে মুক্তি দিয়ে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু হিলিব অভিযোগ করেছেন, বন্দী অবস্থায় তিনি খুব বেশি চিকিৎসাসেবা পাননি।
মুক্তির কয়েক সপ্তাহ পর বিবিসি প্রথমে হিলিবের সঙ্গে কথা বলেছে। পরে তাঁকে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর লিভিভের একটি হাসপাতালে দেখা গেছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে রিসেক্স।
হিলিব বলেন, ‘নিম্নাঙ্গে আঘাতের পরে আমার বেশ সমস্যা হয়েছিল। এটা নিরাময়ে অনেক সময় লেগেছে। এটার কারণ (যৌন সমস্যা) নিয়ে খুব বেশি কথা বলা হয়নি। তাই অন্যদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটুক, তা আমি চাই না। আর যৌনজীবন স্বাভাবিক করে তুলতে রিসেক্স প্রকল্প অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।’
রিসেক্স প্রকল্পের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইভোনা কস্টিনা। তিনি বলেন, মার্কিন সেনারা যুদ্ধের পর এ রকম সমস্যায় পড়েছিলেন। সে ঘটনা জানার পর ২০১৮ সালে প্রথম তাঁরা এ প্রকল্পের ধারণা পেয়েছিলেন।
ইউক্রেনে রাশিয়া পুরোদমে হামলা শুরু করার পর ইভোনারা এ প্রকল্পের তহবিল নিশ্চিত করে ফেলেন। এরপর তাঁরা ইউক্রেনের সেনা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নারী বা পুরুষ, যাঁদেরই যৌনতা–সংক্রান্ত বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন, তাঁদের এ সহায়তা দিতে ইভোনারা প্রস্তুত।
ইভোনা বলেন, শুরুতে বিভ্রান্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন তাঁরা। জনগণ ও যোদ্ধাদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। প্রকল্পের শুরুতে প্রথম যখন অনলাইনে প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছিল, তখন অনেকেই বলেছিলেন ‘মানুষ মারা যাচ্ছে, আর আপনারা আছেন যৌনতা নিয়ে!’
আবার নিজেদের কিছু পূর্বধারণাও ভুল ছিল ইভোনাদের। যেমন সব আহত যোদ্ধাই তাঁদের যৌনজীবনের সঙ্গে লড়াই করছেন—এটি বড় ভুল ধারণা ছিল। তিনি বলেন, ‘আসলে হাসপাতাল, বাড়ি থেকে শুরু করে সবখানেই তো যৌনতা আছে। সামগ্রিকভাবে আমরা অনেক বেশি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।’
রিসেক্স প্রায় ছয় হাজার পুস্তিকা মুদ্রণ করে ইউক্রেনের চারপাশে চিকিৎসাকেন্দ্র, অভিজ্ঞ সৈনিক ও তাঁদের পরিবারের কাছে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া এই পুস্তিকাগুলো অনলাইনেও সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছে। এ ছাড়া এই দাতব্য সংস্থা ভিডিও, গ্রাফিকস, একটি হেল্পলাইনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচারণাও চালু করেছে। সংস্থাটি তাদের প্রচারণায় স্বমেহন থেকে শুরু করে সেক্স টয়, এমনকি মৌলিক জীববিজ্ঞান পর্যন্ত সবকিছুই রেখেছে।
ইভোনা বলেন, ‘আমরা সবকিছুই রাখার চেষ্টা করি। পুস্তিকাটিতে যেসব আহত যোদ্ধা এখনো কুমার বা কুমারী, তাঁদের জন্য একটি বিশেষ অংশও আছে। তাই তাঁদের আহত হওয়ার পরের যৌনতা হবে প্রথম যৌনতা, যা তাঁরা কখনো কল্পনা করেননি।’
রিসেক্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ক্যাটেরিনা স্কোরোখড বলেন, তাঁরা নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা নির্দেশিকা প্রকাশ করেছেন, যাতে সংশ্লিষ্ট সঙ্গী বা সঙ্গিনীদের তাঁদের অভিজ্ঞতা ও শরীরের সঙ্গে মানানসই নির্দিষ্ট পরামর্শ দেওয়া হয়; যদিও এই প্রকল্পের লক্ষ্য শারীরিক দিকের তুলনায় মানসিক দিকই বেশি।
ক্যাটেরিনা আরও বলেন, ‘আপনি কীভাবে নিজেকে গ্রহণ করতে পারেন, কীভাবে নিজেকে ভালোবাসতে পারেন এবং যুদ্ধে আহত হওয়ার পরে যৌনতা ও সম্পর্কের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে কীভাবে নিজের ও সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন—এসব নিয়েই এ প্রকল্প।’ তিনি বলেন, তাঁরাও ইউক্রেনের অভিজ্ঞ সেনাদের সম্পর্কেও অনেক কিছু শিখেছেন। বিশেষত, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে মস্তিষ্কের আঘাত প্রায়ই নির্ণয় করা হয় না। আর এমন আঘাত ‘কামনা ও সম্পূর্ণ যৌনকর্মক্ষমতাকে খুব বেশি’ প্রভাবিত করে।
এদিকে ইভোনা বলেন, যৌনতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ব্যবহৃত ভাষাটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি অবশ্যই কোনো নাটকীয় ভাষা নয়। তা অবশ্যই বাধা অতিক্রম করার মতো বিষয় নয়। এসব ভাষা সম্ভবত খেলাধুলার জন্য ভালো। আর সবার যৌনতার মাত্রাও একই নয়।’ তিনি আরও বলেন, এটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যে আহত যোদ্ধারা জানেন, তাঁরা না চাইলে তাঁদের শারীরিক সংসর্গ করতে হবে না। আর শুরুতে শারীরিক সংসর্গ তাঁদের জন্য কঠিন বা বেদনাদায়কও হতে পারে।
রিসেক্স প্রকল্পে যোগ দিয়ে হিলিব স্ট্রাইজকো এ প্রকল্প সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলেছেন। যুদ্ধে এ রকম ভয়াবহভাবে আহত হওয়ার পর আপনার সঙ্গিনী পাশে আছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি শুরুতে হেসেছেন।
পরে হিলিব বলেন, ‘বন্দিদশা ও হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর আমার একজন প্রেমিকা ছিল। এরপর যখন এই প্রকল্পের প্রশ্নপত্র তৈরি করছিলাম, তখন জীবনে আরেকজন প্রেমিকা আসে। এখন আমার একজন সঙ্গিনী আছে। একজনের কথা আমার খুব মনে পড়ে।’
গত এক বছর হিলিব স্ট্রাইজকো যাঁদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য প্রতিটি সঙ্গীই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’