ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্তে ইউরেশিয়া অঞ্চলে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্তে ইউরেশিয়া অঞ্চলে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে

এ বছরেই কি যুদ্ধে হারা শুরু করতে পারে ইউক্রেন

দুই বছর হতে চলল রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের। এখনো এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এ নিয়ে কোনো সমঝোতার আশাও দেখা যাচ্ছে না এখনই। এরই মধ্যে কিয়েভের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ক্ষয়ে এসেছে। এতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আরও উজ্জীবিত। স্বাভাবিকভাবেই, চলমান সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

এ অবস্থায় ইউক্রেন তো বটেই, বিশ্ববাসীর জন্যও ২০২৪ সাল হচ্ছে যুদ্ধের আরেকটি বছর। লড়াই এগিয়ে নিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টই যে শুধু কোমর বেঁধে লেগেছেন, তা নয়। রুশ বাহিনীর কাছে হারানো এলাকাগুলো ফিরে পেতে ইউক্রেনও লড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। বিশ্লেষক ও কূটনীতিকেরা বলছেন, যুদ্ধের দুই বছর পর এসে কিয়েভের পুরোপুরি আত্মসমর্পণেই কেবল তুষ্ট হবেন ভ্লাদিমির পুতিন।

চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী টক শো আয়োজক, ভাষ্যকার ও লেখক টাকার কার্লসনকে প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারেন যে তিনি সমঝোতায় আগ্রহী। তবে তা হতে হবে অনেকটাই মস্কোর চাওয়ামতো। কিন্তু কিয়েভ এমন আলোচনায় আগ্রহ দেখাবে না বলে মত বিশ্লেষকদের।

২০২২ সালের শীত মৌসুম ছিল পুতিনের জন্য অপমানকর। ওই সময় কয়েক দিনের মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলে তিনি ব্যর্থ হন। অবশ্য এখন তিনি সুসংহত। দৃশ্যত, ইউক্রেনের অসফল পাল্টা আক্রমণ, আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরার সম্ভাবনা ও ইউরোপজুড়ে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান-এসব বিষয় পুতিনকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।

মস্কোয় ক্রেমলিনের সঙ্গে যুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কাউন্সিল অন ফরেন অ্যান্ড ডিফেন্স পলিসি’র প্রধান ফায়োদর লুকায়ানভ বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় আমি শিগগিরই কোনো আলোচনা হওয়ার লক্ষণ দেখছি না। এখানে এমন কিছু নেই, যা নিয়ে সমঝোতা হতে পারে।’

২০২২ সালের শীত মৌসুম ছিল পুতিনের জন্য অপমানকর। ওই সময় কয়েক দিনের মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলে তিনি ব্যর্থ হন। অবশ্য এখন তিনি সুসংহত। দৃশ্যত, ইউক্রেনের অসফল পাল্টা আক্রমণ, আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরার সম্ভাবনা ও ইউরোপজুড়ে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান—এসব বিষয় পুতিনকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (বাঁয়ে) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবিটি ইউক্রেনে সর্বাত্মক রুশ হামলা শুরুর আগে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে এলিসি প্রাসাদে তোলা

সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট পুতিন কার্লসনকে বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করাটা কি ইউক্রেনের জন্য বেশি ভালো হতো না?’ এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পুতিন এমন এক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার আহ্বান জানান, যা মস্কোকে ইউক্রেনের ২০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ করে দেবে। পুতিন বলেন, ‘এখনই হোক আর পরেই হোক, আমরা কোনো না কোনো উপায়ে একটা সমঝোতায় উপনীত হব।’

কয়েক মাস ধরে লড়াই চলার পর রুশ সেনারা গত সপ্তাহে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর আভদিভকা দখল করে নিয়েছেন। এটি মস্কোর জন্য প্রতীকী অর্জনস্বরূপ।

সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় আমি শিগগিরই কোনো আলোচনা হওয়ার লক্ষণ দেখছি না। এখানে এমন কিছু নেই, যা নিয়ে সমঝোতা হতে পারে।
—ফায়োদর লুকায়ানভ, কাউন্সিল অন ফরেন অ্যান্ড ডিফেন্স পলিসি’র প্রধান

দখল করা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে রাশিয়া সেনা সরিয়ে না নিলে কোনো সমঝোতা নয়—কিয়েভের দীর্ঘদিনের এ অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলাক। এএফপিকে তিনি বলেন, এর বাইরে অন্য কিছুতে সমঝোতা সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের সমঝোতার আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন ইউরোপীয় এক কূটনীতিকও। তিনি বলেন, যখন ইউক্রেন বাস্তব অর্থেই একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে, শুধু তখনই সমঝোতা হতে পারে।

২০২৪ সালে যুদ্ধে হারা শুরু করতে পারে ইউক্রেন

বৃহৎ প্রতিবেশী রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকিয়ে চলার দুই বছর পর এখন ইউক্রেনের সেনারা ক্লান্ত–শ্রান্ত। আবার, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা এবং কিয়েভকে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে অস্ত্রসহায়তা দিতে ইউরোপের ব্যর্থতা কিয়েভের জন্য এক অনিশ্চয়তা ও বিমর্ষকর অনুভূতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে।

ইউক্রেনের ভেতরও ভাঙন শুরু হয়েছে। জনপ্রিয় সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনিকে সরিয়ে দেওয়ার জেলেনস্কির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে দেশটির নেতৃত্ব পর্যায়ে গুরুতর ফাটলের একটা লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইউক্রেনের ভেতরও ভাঙন শুরু হয়েছে। জনপ্রিয় সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনিকে সরিয়ে দেওয়ার জেলেনস্কির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে দেশটির নেতৃত্ব পর্যায়ে গুরুতর ফাটলের একটা লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিপরীতে, যুদ্ধের এ দুই বছরে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধজনিত প্রাথমিক ধাক্কা ভালোভাবে সামাল দিয়েছে। সেই সঙ্গে নিজ অর্থনীতিকে যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করেছে। বাড়িয়েছে উৎপাদন ও জনশক্তি নিয়োগ। এতেই থেমে নেই। দেশটি কারাগারে ভরছে ইউক্রেন অভিযানের সমালোচকদেরও।

যুদ্ধের প্রতিবাদ জানাতে রাশিয়ার নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো দেশটির বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি গত সপ্তাহে আর্কটিকের কারাগারে আকস্মিকভাবে মারা গেছেন। তাঁর সমর্থকেরা একে হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন।

‘কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টার’–এর পরিচালক আলেকসান্দার গ্যাবুয়েভ সতর্ক করে বলেছেন, আরও সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে, আরও পশ্চিমা সমর্থন আদায় করে ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তেজনা কাটিয়ে ইউক্রেনকে অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উতরে উঠতে হবে।

আলেকসান্দার গ্যাবুয়েভ এএফপিকে বলেন, এখন মূল প্রশ্ন হলো, আগামী ছয় মাসে যুদ্ধের বর্তমান গতিপথ পাল্টে দিতে ইউক্রেন ও এর মিত্ররা পদক্ষেপ নিতে পারবে কি না। কেননা, এখনকার সমস্যা চলতে থাকলে ইউক্রেন ২০২৪ সালে যুদ্ধে হারা শুরু করতে পারে।