ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) জয়ী হলেও তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এমন অবস্থায় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এনএফপির সামনে দুটি পথ খোলা আছে।
এনএফপিকে হয় কমসংখ্যক আসন নিয়েই সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে কাজ করতে হবে। এতে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে এবং কোনো আইন পাস করাতে অন্য পক্ষের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। আর কমসংখ্যক আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে না চাইলে অন্য কাউকে নিজেদের জোটের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
তবে ইউরোপের দেশ জার্মানি কিংবা নরওয়ের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর জোট করে সরকার গঠনের ঘটনা পরিচিত হলেও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না।
ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ৫৭৭টি আসন আছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, নির্বাচনে এনএফপি পেয়েছে ১৮২ আসন, প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর মধ্যপন্থী জোট এনসেম্বল পেয়েছে ১৬৮ আসন, উগ্র ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) পেয়েছে ১৪৩ আসন।
এনএফপি জোটভুক্ত দলের মধ্যে আছে ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টি, ফ্রান্স আনবোড, গ্রিনস ও সোশ্যালিস্ট পার্টি। সামনের কাজগুলো কী হবে, তা নিয়ে দলগুলোর নেতারা গতকাল রোববার রাতেই প্রথম দফার আলোচনা সেরেছেন।
ফ্রান্স আনবোড দলের নেতা জ্যঁ-লিখ মিলোশো বলেছেন, এনএফপি জোট থেকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাই করা উচিত। তবে জোটটির কোনো নেতা নেই। যোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে বেছে নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে জোটের দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে।
ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দ ফিলিপসহ কয়েকজন মধ্যপন্থী নেতা বলেছেন, স্থিতিশীল সরকার গড়ে তুলতে একটি চুক্তির ব্যাপারে কাজ করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত আছেন।
ফ্রান্সের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আতাল বলেছেন, তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। তবে নতুন সরকার গঠনসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের কথা মাথায় রেখে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তা এখনই গ্রহণ করবেন কি না, নিশ্চিত নয়। অবশ্য গ্যাব্রিয়েল আতাল বলেছেন যে তিনি তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় থাকবেন।
আতাল আরও বলেন, ‘যতক্ষণ প্রয়োজন, আমি অবশ্যই আমার দায়িত্ব পালন করে যাব। এটি এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ, অলিম্পিক আসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে আর তা আমাদের দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রথম দফার নির্বাচনে আরএনের বিজয়ের পর বিভিন্ন জনমত জরিপে বলা হয়েছিল, দ্বিতীয় দফার নির্বাচনেও দলটি সহজেই বিজয়ী হবে।
প্রথম দফা ভোটের পর অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে আসা ন্যাশনাল র্যালিকে নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন ফ্রান্সের উদার ও মধ্যপন্থীরা। তাই আরএনকে ঠেকাতে বামপন্থী ও মধ্যপন্থী জোটের মধ্যে সমঝোতা হয়। আরএনের বিরুদ্ধে পড়া ভোটগুলো যেন একজনই পান, সে জন্য এই দুই জোট মিলে দুই শতাধিক প্রার্থীকে ভোট থেকে সরিয়ে দেন। বাম ও মধ্যপন্থীদের এই কৌশলই কাজে দিয়েছে।
লো পেনের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত আরএন নেতা জর্দান বারদেলা আরএনবিরোধীদের এভাবে একজোট হওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, এ ধরনের কর্মকাণ্ড ফ্রান্সকে অচল করে দেবে।
তবে জয় না পেলেও আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের নির্বাচনে আরএনএর বড় ধরনের অর্জন হয়েছে। আর তাই দলকে নিয়ে আশাবাদী লো পেন। তিনি বলেছেন, এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বীজ বপন করে রেখেছে আরএন। ফ্রান্সে ২০২৭ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলটির হয়ে লো পেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে মনে করা হয়ে থাকে।
লো পেন বলেন, ‘আমাদের জয় বিলম্বিত হচ্ছে, এতটুকুই যা।’
সমঝোতা না হলে কী হবে?
নির্বাচন–পরবর্তী জোট গড়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে সমঝোতা না হলেও ফ্রান্সের সংবিধান অনুসারে ১২ মাসের মধ্যে মাখোঁ নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবেন না।
সংবিধানে বলা আছে, কাকে সরকার গঠন করতে বলা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট তথা মাখোঁ। তবে তিনি যাঁকেই বেছে নেন না কেন, তাঁকে জাতীয় পরিষদে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে হবে। ১৮ জুলাই এ ভোটাভুটি হতে পারে। এর মানে হলো, মাখোঁকে এমন কোনো নাম প্রস্তাব করতে হবে, যেটি বেশির ভাগ আইনপ্রণেতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
মাখোঁ চাইবেন, বামপন্থী জোট থেকে সোশ্যালিস্ট ও গ্রিনসরা ঝরে যাক। এতে একা হয়ে পড়া ফ্রান্স আনবোডের সঙ্গে মিলে মধ্য-বামপন্থী জোট গঠন করবেন। যদিও এখন পর্যন্ত নিউ পপুলার ফ্রন্টের মধ্যে ভাঙনের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
গতকাল রাতে বামপন্থী সমর্থকদের ব্যাপক বিজয়োল্লাস করতে দেখা গেছে। উদযাপনে শামিল হয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী ডিজাইনার ব্যাপতিস্তে ফোরাস্তি। তিনি বলেন, ‘আমরা এমনটা আশা করিনি। কোনো জনমত জরিপই এমন আভাস দিতে পারেনি। আমরা আনন্দিত যে ফরাসি জনগণ আরও একবার উগ্র ডানপন্থীদের আটকে দিতে সফল হয়েছে।’
তবে ফোরাস্তির মধ্যে কিছুটা উৎকণ্ঠাও দেখা গেল। তাঁর আশঙ্কা, উগ্র ডানপন্থীদের শক্তি আরও বেড়ে যেতে পারে এবং তারা পরেরবার জিতে যেতে পারে।
ফোরাস্তি বলেন, ঝুলন্ত পার্লামেন্টে কাজ করাটা কঠিন হবে। কিন্তু উগ্র ডানপন্থীদের এগিয়ে থাকার তুলনায় তো অন্তত ভালো কিছু হলো।