ভাগনার যোদ্ধার বয়ানে পুতিনবিরোধী বিদ্রোহ

গত ২৪ জুন বিদ্রোহের সময় রাশিয়ার রোস্তভ–অন–দন শহরের রাস্তায় অবস্থান নেন ভাগনার যোদ্ধারা
 ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেওয়া দেশটির ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী ভাগনার গোষ্ঠীর একজন যোদ্ধা বলেছেন, ওই সময় কী ঘটছিল সে বিষয়ে তিনি ও তাঁর অধীনে থাকা যোদ্ধাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না।

মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন সশস্ত্র বিদ্রোহের অবতারণা করেন। যোদ্ধাদের ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রোস্তভে পাঠান। ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওই শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ভাগনার যোদ্ধাদের মস্কোর দিকে আরও এগিয়ে নেন প্রিগোশিন।

ভাগনার যোদ্ধারা সচরাচর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন না। তবে বিবিসি রাশিয়া একজন জুনিয়র কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়েছে, যিনি ঘটনাচক্রে ওই বিদ্রোহ অংশ নিয়েছিলেন।

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতীকে পরিণত হওয়া দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় বাখমুত শহর দখলের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন গ্লেব নামের এই কমান্ডার। অবশ্য এটি তাঁর প্রকৃত নাম নয়।

ভাগনার যোদ্ধাদের সঙ্গে রাশিয়ার ভাড়াটে এই বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন

বিদ্রোহ শুরুর সময় গ্লেব রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউক্রেনের লুহানস্ক অঞ্চলে ব্যারাকে নিজ সেনাদের সঙ্গে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ২৩ জুন ভোরের দিকে ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়া ভাগনার যোদ্ধাদের একটি বহরে যোগ দিতে তিনি ফোন পান।

একজন ভাগনার কমান্ডার এই নির্দেশ দেন। নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ওই কমান্ডারের নাম প্রকাশ করতে চাননি গ্লেব। অবশ্য ওই কমান্ডার প্রিগোশিন ও ভাগনার কমান্ড কাউন্সিলের নির্দেশ মোতাবেকই কাজটি করেছিলেন।

ওই কমান্ডার গ্লেবকে বলেন, ‘এটা পূর্ণ মোতায়েন। আমরা একটি বহর গড়তে যাচ্ছি, চলো বেরিয়ে পড়ি।’

রাশিয়ার রাজধানী মস্কো অভিমুখী সড়কে ভাগনার যোদ্ধারা

গ্লেব বলেন, কেউই জানত না বহরটি কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তবে তিনি বিস্মিত হন, যখন বুঝতে পারলেন তাঁরা সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাচ্ছেন।

এই কমান্ডার বলেন, যখন ভাগনার যোদ্ধারা রাশিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে রোস্তভ অঞ্চলে প্রবেশ করছিল, তখন তারা একেবারে কোনো ধরনের প্রতিরোধের মুখেই পড়েনি।

ওই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে গ্লেব বলেন, ‘আমি কোনো সীমান্তরক্ষীকে দেখিনি। অবশ্য পুরো যাত্রা পথে ট্রাফিক পুলিশ আমাদের স্যালুট দিয়েছিল।’

ভাগনারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম (বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ) চ্যানেলগুলো পরে দাবি করেছিল, ভাগনার যোদ্ধারা পৌঁছালে বুগায়েভকা তল্লাশিচৌকির সীমান্তরক্ষীরা অস্ত্র সমর্পণ করেন।

যেভাবে ভবন নিয়ন্ত্রণ

রোস্তভ-অন-দন পৌঁছালে শহরের আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার সব ভবন ঘেরাও এবং সামরিক বিমানবন্দর দখল করার নির্দেশ দেওয়া হয় ভাগনার যোদ্ধাদের। গ্লেবের ইউনিটকে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) আঞ্চলিক কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে বলা হয়।

যখন তাঁরা ভবনটির দিকে এগিয়ে যান, তখন এটাকে সম্পূর্ণভাবে তালাবদ্ধ এবং ফাঁকা মনে হয়েছিল। সেখানে কেউ আছে কি না খুঁজে দেখতে একটি ড্রোন উড়ানো হয়। অবশেষে আধা ঘণ্টা পর একটি দরজা খোলা হয় এবং দুজন রাস্তায় বেরিয়ে আসেন।

গ্লেব বলেন, ‘তাঁরা বললেন, বন্ধুরা চলো একটি সমঝোতায় পৌঁছাই। আমি বললাম, এখানে চুক্তি করার কি আছে? এটা আমাদের শহর।’ তিনি বলেন, ‘তাই আমরা কেবল এ বিষয়ে সম্মত হয়েছিলাম যে, আমরা একে অপরের থেকে আলাদা থাকব। তাঁরা মাঝেমধ্যে ধূমপান করতে আসতেন।’

শহরের ভেতরে-বাইরের অন্য সরকারি ভবনগুলোর পরিস্থিতিও একই রকম ছিল বলে রোস্তভের সাংবাদিকেরা জানিয়েছিলেন। ভাগনার যোদ্ধারা এসব ভবনের ওপর প্রথমে ড্রোন উড়ান এবং পরে সেগুলো ঘেরাও করেন। কাউকে ভবন থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। অবশ্য ভবনে খাবার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

কোনো ব্যাখ্যা নেই

এসব যখন ঘটছিল, ভাগনারপ্রধান প্রিগোশিন তখন রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সাদার্ন মিলিটারি ডিস্ট্রিক্টের সদর দপ্তরে দেশটির উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইউনুস-বেক ইয়েভকুরভ ও ডেপুটি চিফ অব দ্যা জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভ্লাদিমির আলেক্সিয়েভের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন।

বৈঠকে প্রিগোশিন দাবি করেন, তাঁরা যেন সেনাপ্রধান ভালেরি গেরাসিমভ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। প্রিগোশিন বৈঠকে থাকার সময়ই, ভাগনার বাহিনীর আরেকটি বহর অগ্রসর হতে শুরু করে।

গ্লেব নিশ্চিত করেন, ওই বহরটির নেতৃত্বে ছিলেন ভাগনারের প্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উতকিন। স্পেশাল ফোর্সের সাবেক এই কর্মকর্তাকে খুব কমই প্রকাশ্যে দেখা যায়। গ্লেব বলেন, বহরটি ভরোনেঝের দিকে মূল মহাসড়কে ছিল এবং দৃশ্যত মস্কোর উদ্দেশে রওনা হয়েছিল।

ভাগনার বাহিনী সামরিক সরঞ্জাম হস্তান্তর করছে

তাহলে গ্লেব কি পরিকল্পনাটি জানতেন— প্রিগোশিন কী করতে চেয়েছিলেন বা করার পরিকল্পনা করেছিলেন? শপথ করে স্পষ্টভাবে তিনি বললেন, কী কারণে এসব ঘটছিল, সেসবের কিছু তিনি জানতেন না। গ্লেব বলেন, ‘কী ঘটছিল আমরা টেলিগ্রাম থেকে জানতে পারি, ঠিক আপনাদের মতোই।’

দিন গড়াতেই রোস্তভে কী ঘটছিল তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ জুন সন্ধ্যায় গ্লেবের সঙ্গে তাঁর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যোগাযোগ করেন। তাঁকে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা না দিয়েই তিনি এবং তাঁর ইউনিটকে লুহানস্কের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বলেন।

গ্লেব ও তাঁর ইউনিটের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তাঁদেরকে লুহানস্কের ব্যারাকে অবস্থান করতে এবং পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা থাকতে বলা হয়েছে। কেন ভাগনার ছাড়ছেন না এমন প্রশ্নের সরল উত্তর গ্লেবের, ‘আমার চুক্তির মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি।’