অ্যালেক্সি নাভালনির প্রতি শোক প্রকাশে তাঁর ছবি হাতে জড়ো হয়েছেন অনেকে। রুশ দূতাবাসের সামনে, ওয়ারশ, পোল্যান্ড, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
অ্যালেক্সি নাভালনির প্রতি শোক প্রকাশে তাঁর ছবি হাতে জড়ো হয়েছেন অনেকে। রুশ দূতাবাসের সামনে, ওয়ারশ, পোল্যান্ড, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত কি না, প্রায়ই এমন প্রশ্নের মুখে পড়তেন নাভালনি

এমনটা একটা সময় ছিল, রাশিয়ায় বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে যখন প্রায়ই শুনতে হতো, ‘আপনি এখনো বাইরে আছেন?’ সাংবাদিকেরা ওই সময় তাঁর কাছে আরও জানতে চাইতেন, তিনি তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত কি না।

পরে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে তাঁর শরীরে ‘নোভিচোক’ নামে বিষপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে। উন্নত চিকিৎসার জন্য নাভালনিকে জার্মানিতে নেওয়া হয়। নিশ্চিত কারাবাস হবে জানার পরও জার্মানিতে কয়েক মাস চিকিৎসা নিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফেরেন তিনি। তখন থেকে কারাগারেই ছিলেন।

বিষপ্রয়োগে হত্যাচেষ্টার পর থেকে সাংবাদিকেরা নাভালনিকে আর ওই সব প্রশ্ন করতেন না।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কঠোর সমালোচক ৪৭ বছর বয়সী নাভালনি। গত এক দশকে রাশিয়ায় বিরোধী নেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

গত বছরের শেষ দিকে নাভালনিকে উত্তর সাইবেরিয়ার ইয়ামালো-নেনেটস অঞ্চলের কারা কলোনিতে নেওয়া হয়। বন্দীদের ওপর নিষ্ঠুরতার কুখ্যাতি রয়েছে এ কারাগারের। গতকাল শুক্রবার রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে মারা গেছেন নাভালনি।

রাশিয়ায় এক দশকের বেশি সময় রাজপথে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন নাভালনি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পুতিন প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতির তথ্য নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তুলে ধরতেন তিনি। কোটি কোটি মানুষ তা দেখেতেন। নাভালনির ডাকে হাজারো মানুষ রাজপথে নেমে এসে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে শামিল হতেন।
এসব কারণে পুতিন ও ক্রেমলিনের চক্ষুশূল ছিলেন নাভালনি। এমনকি পুতিন তাঁর নাম উচ্চারণ করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছিল, পুতিনের ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে কারাবন্দী নাভালনি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারেন।  

২০২০ সালের আগস্টে সাইবেরিয়া থেকে একটি উড়োজাহাজে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ফিরছিলেন। নাভালনি ওই উড়োজাহাজে ছিলেন। পরে সমস্যা দেখা দেওয়ায় পাইলট উড়োজাহাজটির জরুরি অবতরণ করান। তা না হলে ওই সময় বড় কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারত।

জার্মানিতে যখন নাভালনির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়, তখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি নাশকতার শিকার হয়েছিলেন। কেননা, নাভলনির শরীরে যে বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেটা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের তৈরি। এখন সেটা রুশ সেনাবাহিনী ব্যবহার করে।

আরেকটি বিষয় হলো, বড়সড় একটি প্রতিবাদ সমাবেশে জড়ো হওয়ার সময়ই নাভালনির সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছিল।

জার্মানিতে যখন নাভালনি সুস্থ হয়ে উঠলেন, তখন তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন, রাশিয়ায় তিনি মোটেও নিরাপদ নন। আবার তাঁর ওপর আঘাত আসতে পারে। এমনকি দেশে ফিরলে গ্রেপ্তার করা হতে পারে, নাভালনিকে আগেই এ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু প্রবাসে থেকে রাজনীতি করলে দেশের মানুষের সংস্পর্শে আসা যায় না। সেই রাজনীতিককে ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে হয়। এমন ভাবনা থেকে রাশিয়ায় ফেরেন তিনি। মানুষকে রাজপথে বের করে আনার দুর্দান্ত ক্ষমতা ছিল নাভালনির।

রাশিয়ায় নাভালনির রাজপথের সংগ্রাম, আদালতে আইনি লড়াই কিংবা ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার প্রচেষ্টা—কোনোটাই সহজ ছিল না। তিনি যে সবার পছন্দের পাত্র ছিলেন, এমনটাও নয়। পদে পদে তাঁকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করে এরপর এগিয়ে যেতে হয়েছে।

তবে নাভালনির যে গুণ নজর কাড়ে, তা হলো তিনি ভালো বক্তৃতা দিতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জনমত গঠনেও পটু ছিলেন তিনি। নিজের কাজ নিয়ে ভীষণ গতিশীল, উদ্যমী ও উৎসাহী মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি পুতিন ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বরাবরই ‘দুর্বৃত্ত ও তস্কর’ বলে সমালোচনা করতেন।

নিজের ভবিষ্যৎ জানা থাকা সত্ত্বেও ২০২১ সালের জানুয়ারিতে নাভালনি যখন রাশিয়ায় ফেরেন, সেটা কাউকে অবাক করেনি। ওই সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করার ঘটনাও অবাক করা ছিল না। পরবর্তী সময়ে আদালতে, এরপর কারাগারে থেকে তিনি কথা বলা শুরু করেন।

একাধিক মামলায় কারাগারে থেকেই ভিডিও লিংকে শুনানিতে অংশ নিতেন নাভালনি। নানা অজুহাতে তাঁর কারাবাসের মেয়াদ বাড়ছিল। সর্বশেষ দেখা এক ভিডিওতে দেখা যায়, নাভালনির মাথা মুড়ানো হয়েছে। তাঁকে কারাগারের পোশাক পরতে দেওয়া হয়েছে। ওই পোশাকে তাঁকে দেখতে বেশ রোগা লাগছিল।

মারা যাওয়ার আগে প্রকাশিত সর্বশেষ ভিডিওতে নাভালনিকে মজা করতেও দেখা গেছে।