ইরাক-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সময় কিছু অস্ত্রের নাম বেশি শোনা যেত। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল স্কাড এবং প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এবার শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু অস্ত্রের নাম। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘কামিকাজে ড্রোন’।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে আট মাস ধরে। এরই মধ্য দুই পক্ষে হাজারো মানুষ হতাহত হয়েছেন। এরই মধ্য ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রীয় শেভচেনকিভস্কি এলাকায় সোমবার দফায় দফায় বিস্ফোরণ হয়েছে। এক সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে এলাকাটি। ইউক্রেন বলছে, ইরান নির্মিত শহীদ ‘কামিকাজে’ ড্রোনে হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এটা রাশিয়ার অন্যতম প্রাণঘাতী হামলা।
১০ অক্টোবর নতুন করে শুরু হওয়া হামলাগুলো ইউক্রেনের ১০টি অঞ্চল লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছে। ইউক্রেন বলছে, রুশ মিসাইলের পাশাপাশি ইরানের তৈরি ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে হামলায়। ইউক্রেন বলছে, ইরানের তৈরি শহীদ-১৩৬ বা কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করছে। ইউক্রেন বিমানবাহিনী বলেছে, দিনভর তারা ৩৭টি ড্রোন ধ্বংস করেছে।
সোমবারের হামলার পরই ‘কামিকাজে’ ড্রোন নিয়ে আলোচনা চলছে, বিস্ফোরকবোঝাই চালকবিহীন ড্রোন দিয়ে কীভাবে হামলা হয়, কার কার হাতে এ ড্রোন আছে, কতটা ধংসাত্মক এ ড্রোন।
শহীদ-১৩৬ বা কামিকাজে ড্রোনগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র বা অন্যান্য স্থাপনা বা স্থির বস্তুতে হামলা চালানোর জন্য বেশ কার্যকর। সামরিক বাহিনীর ওপর এগুলো ব্যবহারে অতটা সফলতা পাওয়া যায় না। এ জন্য ইউক্রেনের জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক আকারে ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যেই কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করছে রাশিয়া। ছোট প্রাণঘাতী এ ড্রোনগুলো রাডারে শনাক্ত করা কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল, ইরান ও তুরস্কের কাছেও এ ধরনের ড্রোন রয়েছে।
কামিকাজে শব্দটির উৎপত্তি হলো জাপানে। অর্থ আত্মঘাতী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা কৌশল হিসেবে এটি ব্যবহার করত। কৌশল হলো শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে বিমানসহ আত্মঘাতী হামলা করা, যেন শত্রুপক্ষের সর্বোচ্চ ক্ষতিটা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ শাখাকে বলা হতো ‘কামিকাজে স্পেশাল অ্যাটাক ইউনিট’। ইরানের শহীদ-১৩৬ ড্রোনগুলো হলো আত্মঘাতী ড্রোন। লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার জন্য এগুলো এগিয়ে। কিন্তু ড্রোন থেকে কোনো কিছু ছোড়া হয় না।
ড্রোনটিই গিয়ে সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে এবং ধ্বংস হয়ে যায়। এ কারণে এগুলো কামিকাজে বা আত্মঘাতী ড্রোন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ইরানের তৈরি শহীদ-১৩৬ ড্রোন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম দেখা যায় সেপ্টেম্বরে। এগুলোকে ছোট ক্রুজ মিসাইল হিসেবে দেখা হয়। একসময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, রাশিয়া এ রকম ২ হাজার ৪০০টি ড্রোন কিনেছে, যদিও এগুলো দ্রুত কমে আসছে।
আল–জাজিরার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অ্যালেক্স গ্যাটোপোলোস বলেন, ‘লক্ষ্য শনাক্ত করার আগে এ অস্ত্রগুলো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ওপরে ঘোরাফেরা করতে পারে। এরপর লক্ষ্যে হামলে পড়ে।’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো এগুলো শত শত কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। তবে ক্রুজ ব্যয়বহুল। গ্যাটোপোলোস বলেন, কামিকাজে ড্রোন সস্তা কিন্তু চমৎকার বিকল্প।
এ ড্রোনগুলোকে ‘সুইচব্লেড ড্রোন’ও বলা হয়। এই ড্রোনগুলো ছোট মানববিহীন বিমান, যা বিস্ফোরকে পরিপূর্ণ থাকে। উড়তে শুরু করার সময় এগুলোর ডানা ব্লেডের মতো বেরিয়ে আসে বলে এগুলোকে ‘সুইচব্লেড ড্রোন’ বলা হয়। লক্ষ্যবস্তুকে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম এ আত্মঘাতী ‘কামিকাজে ড্রোন’। ট্যাংক মুহূর্তে গুঁড়িয়ে দিতে বা শত্রু সেনাবাহিনীর একটি দল নিমেষের মধ্যে খতম করতে সক্ষম এ ড্রোন। একবারই ব্যবহারযোগ্য ড্রোনগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্য ড্রোনগুলোর তুলনায় অনেকটাই সস্তা।
যুক্তরাষ্ট্রেরও কামিকাজে ড্রোন আছে। এ ড্রোন মূলত দুটি আকারে পাওয়া যায়। সুইচব্লেড ৩০০ এবং সুইচব্লেড ৬০০। সুইচব্লেড ৩০০-এর ওজন প্রায় পাঁচ পাউন্ড (প্রায় আড়াই কিলোগ্রাম)। অপেক্ষাকৃত হালকা ড্রোনটি একটানা ১৫ মিনিট পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। সুইচব্লেড ৬০০ ড্রোনটি তুলনামূলকভাবে আকারে এবং ওজনে বড়। এ ড্রোনের ওজন প্রায় ৫০ পাউন্ড (প্রায় সাড়ে ২২ কিলোগ্রাম)। এ ড্রোনগুলো টানা ৪০ মিনিট পর্যন্ত উড়তে পারে।
২০১০ সালে আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় তালেবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সেনারা ‘কামিকাজে ড্রোন’ ব্যবহার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যরা এ ড্রোনকে ‘ফ্লাইং শটগান’ বলেন।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় এ কামিকাজে ড্রোনগুলো অনেক সস্তা। একটি ড্রোনের মূল্য প্রায় ২০ হাজার ডলার। লন্ডনের কিংস কলেজের বিশ্লেষক সামির পুরি বলেন, একটি অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করলে দাম নেহাত কম নয়।
ইউক্রেন বলছে, ইরান থেকে ড্রোনগুলো আমদানি করেছে রাশিয়া। তেহরানে এগুলো শাহেদ-১৩৬ নামে পরিচিত। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক গ্যাটোপোলোস বলেন, ‘ড্রোনগুলো রাশিয়ায় তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, এ ধরনের সশস্ত্র ড্রোন বিকাশে পিছিয়ে রয়েছে মস্কো।’
লন্ডনের কিংস কলেজের বিশ্লেষক সামির পুরি বলেন, ‘মস্কো ও তেহরানের মধ্যে একটা চুক্তির সম্ভাবনা আছে। এ ড্রোনগুলো ইরান থেকে কেনা হয়েছিল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমার মনে হয়, ড্রোনগুলোতে আরও কোনো প্রযুক্তি যুক্ত করেছে রাশিয়া। এতে ড্রোনগুলো ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষাকে বিভ্রান্ত করতে পারছে।’
ঝাঁকে ঝাঁকে হামলা করে বলে ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র ডিফেন্স সিস্টেমও এগুলোকে সম্পূর্ণভাবে রুখে দিতে অক্ষম। ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেছেন, ঝাঁকে ঝাঁকে এসব ড্রোনের ব্যবহার ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষার জন্য শক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
এ ড্রোনকে ভূপাতিত করতে পারে, এমন ব্যবস্থা কিয়েভকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পশ্চিমারা। তবে সেসবের বেশির ভাগই এখনো ইউক্রেনে পৌঁছায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ‘কামিকাজে’ প্রতিহত করার সরঞ্জাম পেতে কিয়েভকে আরও মাসখানেক অপেক্ষা করতে হবে।
সামি পুরি বলেন, ‘যদিও চালকবিহীন বিমানের মোতায়েন ইউক্রেনকে শক্ত চ্যালেঞ্জে ফেলবে, তবে এতে “গেম চেঞ্জের” সুযোগ খুব কম।’ তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা, রয়টার্স ও বিবিসি