যুদ্ধের ময়দানে রুশ বাহিনীকে রুখতে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম (এম-১৪২ হিমার্স) সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই সমরাস্ত্র চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। হিমার্সের মালিকানা পেতে তৎপর হয়েছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। ভবিষ্যতে রুশ হামলার শঙ্কা থেকেই তাদের এই তোড়জোড়।
বিপুল অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে হিমার্স আনতে ফরমাশ দিয়েছে পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলো। পোল্যান্ড ৫০০টি হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও গোলাবারুদ কিনতে চায় বলে গত ২৬ মে জানিয়েছে দেশটির সরকার। এস্তোনিয়া ৫০ কোটি ডলার খরচ করে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার ছয়টি ইউনিট ও গোলাবারুদ কিনতে পারে বলে গত ১৫ জুলাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। এক সপ্তাহ বাদেই লাটভিয়া ৩০ কোটি ডলার দিয়ে হিমার্স ও রকেট কিনবে বলে ঘোষণা দেয়। একই পথে হাঁটছে লিথুয়ানিয়াও।
সম্প্রতি কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্যবাহী জাহাজগুলো চলাচলের সুযোগ দিতে সম্মতি জানিয়ে চুক্তি করেছে রাশিয়া। এ নিয়ে লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডবার্গিস গত ২২ জুলাই বলেন, ‘হিমার্স ছাড়া ওদেসা বন্দর ইউক্রেনের ব্যবহারের সুযোগ পাওয়াটা অসম্ভব ছিল। এখন এটা খুবই পরিষ্কার যে, আমরা যদি ইউক্রেনকে দ্রুত অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করি তাহলে যুদ্ধ আগেভাগেই শেষ হবে।’
সমরবিদেরা বলছেন, হিমার্সের এই নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারার মূলে রয়েছে বিশেষ নেভিগেশন ব্যবস্থা। এতে ব্যবহার করা হয়েছে গাইরোস্কোপ ও এক্সেলেরোমিটার সেন্সর। এর ফলে লক্ষ্যবস্তুর নির্ভুল অবস্থান শনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পরিচালনাকারীকে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হয়। ইউক্রেনকে এ ধরনের গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের কথা নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা।
লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া উন্নত প্রযুক্তির ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার ‘এটিএসিএমএস’ (আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল) ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়ে কথা বলেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার দরকার হয়। দূরপাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে এস্তোনিয়া সীমান্ত থেকে সহজেই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে আঘাত হানা যাবে। আর লাটভিয়া থেকে মস্কো লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছুঁড়লে তা অর্ধেক পথ অতিক্রম করতে পারবে। এর অর্থ, দেশটির সীমান্তের কাছে রুশ বাহিনী পৌঁছানোর আগেই তাদের ওপর হামলা চালানো যাবে। অপর দিকে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার সীমান্ত থেকে বেলারুশের প্রায় সব জায়গায় হামলা চালানো সম্ভব। বেলারুশ রাশিয়ার আঞ্চলিক মিত্র।
ইউক্রেন মাত্র আটটি হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা ব্যবহার করে রাশিয়ার গোলাবারুদের মজুত, কমান্ড পোস্ট ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ছয়টি টিউব রয়েছে। এগুলো দিয়ে সাধারণ পাল্লার জিএমএলআরএস (গাইডেড মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমস) ছোড়া হয়েছে। এগুলো মাত্র ৮০ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
ওই আটটি হিমার্স গত ২৫ জুন হাতে পায় ইউক্রেন। এরপর থেকে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে সেগুলো ব্যবহার করে রুশ বাহিনীর অন্তত ৩০টি সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে বলে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এক সপ্তাহ বাদেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন সূত্র জানিয়েছিল, হিমার্স দিয়ে রাশিয়ার প্রায় ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে।
তবে হিমার্স নিয়ে ইউক্রেনের সফলতার দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছে ক্রেমলিন। তারা উল্টো বলছে, ইউক্রেনে হিমার্সের গোলাবারুদের গুদামে হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী।
হিমার্স ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের হিসাবনিকাশ বদলে দিয়েছে বলে মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মিক রায়ান। এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে ‘গেম চেঞ্জার’ অভিহিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মার্ক হের্টলিং। তাঁর মতে, যুদ্ধে ইউক্রেন বাহিনীর সুবিধাজনক অবস্থান পেতে সহায়তা করছে হিমার্স।
যুদ্ধক্ষেত্রে হিমার্সের সক্ষমতা নিয়ে কথা বলেছেন গ্রিসের হেলেনিক আর্মি অ্যাকাডেমিতে উন্নত প্রযুক্তির সমরাস্ত্র ব্যবস্থা সম্পর্কে পড়ানো কনস্টানটিনোস গ্রিভাস। তিনি বলেন, ‘হিমার্সে জিএমএলআরএস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হলে তা লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানার অসাধারণ সক্ষমতা অর্জন করে। রাশিয়ার হাতে এর সমকক্ষ কিছুই নেই। কারণ, বিভিন্ন পরিবেশে স্নাইপার আর্টিলারির মতো ব্যবহার করতে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন, ইরাকের ফালুজা শহর। সেখানে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আপনাকে নির্ভুলভাবে আঘাত করতে হতো। কারণ, ওই লক্ষ্যবস্তুর আশপাশে অনেক বেসামরিক লোকজন থাকতে পারে।’
সম্প্রতি কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্যবাহী জাহাজগুলো চলাচলের সুযোগ দিতে সম্মতি জানিয়ে চুক্তি করেছে রাশিয়া। এ নিয়ে লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডবার্গিস গত ২২ জুলাই বলেন, ‘হিমার্স ছাড়া ওদেসা বন্দরকে ইউক্রেনের ব্যবহারের সুযোগ পাওয়াটা অসম্ভব ছিল। এখন এটা খুবই পরিষ্কার যে, আমরা যদি ইউক্রেনকে দ্রুত অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করি তাহলে যুদ্ধ আগেভাগেই শেষ হবে।’
সমরবিদেরা বলছেন, হিমার্সের এই নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারার মূলে রয়েছে বিশেষ নেভিগেশন ব্যবস্থা। এতে ব্যবহার করা হয়েছে জাইরোস্কোপ ও এক্সেলেরোমিটার সেন্সর। এর ফলে লক্ষ্যবস্তুর নির্ভুল অবস্থান শনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পরিচালনাকারীকে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হয়। ইউক্রেনকে এ ধরনের গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের কথা নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা।
হিমার্সের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় খরচও তুলনামূলক কম। এর একটি জিএমএলআরএস ক্ষেপণাস্ত্রের দাম প্রায় ১ লাখ ডলার। রাশিয়ার তৈরি কোটি কোটি ডলারের এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে হিমার্স। আর এর ফলে রুশ সেনাদের ওপর যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছে, তা ধারণাতীত বলে উল্লেখ করেছেন সমর বিশ্লেষকেরা।
হিমার্সের মাধ্যমে হামলার শিকার হওয়ার পর রুশ বাহিনী তাদের কিছু সামরিক সরঞ্জাম শহরের কাছাকাছি নিয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ জুলাই রাতে খেরসনের পৌর থিয়েটারে কামানের গোলাবারুদ মজুত করেন রাশিয়ার সেনারা।
তবে শহরগুলোকে প্রতিরক্ষা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে রাশিয়ার এই কৌশল কাজে আসবে না বলে মনে করছেন হেলেনিক আর্মি অ্যাকাডেমির শিক্ষক কনস্টানটিনোস গ্রিভাস। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, শহুরে এলাকায় যুদ্ধের বিষয়টি মাথায় রেখেই হিমার্সের নকশা করা হয়েছে।
হিমার্স নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মিক রায়ান লেখেন, হিমার্স এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহজেই নেওয়া যায়। ফলে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি কোনো জায়গায় থামিয়ে হামলা চালানোর পর আবার দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যায়। এতে করে শত্রুর পাল্টা আক্রমণের মুখে এর টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গত ২০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইউক্রেনে মোট ২০টি হিমার্স মোতায়েনের লক্ষ্য রয়েছে তাদের। তবে সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ বলেছেন, দখল হওয়া অঞ্চলগুলো থেকে রুশ সেনাদের হটাতে তাঁদের ১০০টি হিমার্স প্রয়োজন।
ইউক্রেনের কাছে যুদ্ধ জয়ের অর্থ হলো, রুশ বাহিনীর দখল করা ক্রিমিয়া ও দনবাস অঞ্চল মুক্ত করা এবং এই অঞ্চলগুলো থেকে রুশ সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি হটানো। যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি-৭-ও একই সুরে কথা বলছে।
এদিকে যুদ্ধে সফলতার পরও ইউক্রেনে কেন আরও হিমার্স সরবরাহ করা হলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা দায়িত্বশীল হওয়ার চেষ্টা করছি। তবে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত থাকার বিষয়েও খেয়াল রাখতে হচ্ছে আমাদের। কারণ, ইউক্রেনে হিমার্স পাঠানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মজুত থেকে।’