যুক্তরাজ্যের এক হাসপাতালের নার্স সাত শিশুকে হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এ ছাড়া হাসপাতালের আরও ছয় শিশুকে তিনি হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ওই নার্সের নাম লুসি লেটবি (৩৩)।
লেটবি রক্তে ও পেটে ইনজেকশনের মাধ্যমে বাতাস ঢুকিয়ে, অতিরিক্তি দুধ খাইয়ে, শারীরিক নির্যাতন করে এবং ইনসুলিনের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে শিশুদের হত্যা করেছেন। যুক্তরাজ্যের উত্তর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ক্রাউন কোর্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যের বার্তা সংস্থা পিএ মিডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চাইল্ড ই’ নামে চিহ্নিত একটি শিশুর রক্তে ইনজেকশনের মাধ্যমে বাতাস ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করেন লেটবি। পরদিন ইনসুলিনে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ওই শিশুর যমজ আরও দুই ভাইকে তিনি হত্যার চেষ্টা চালান। লুসি যে হাসপাতালে কাজ করতেন, সেখানে ওই তিন শিশুর একসঙ্গে জন্ম হয়েছিল।
লেটবি যেসব শিশুকে হত্যা করেছেন বা যাদের হত্যার চেষ্টা করেছেন, তাদের নাম গোপন রাখতে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশ লেটবির বাসা তল্লাশি করতে গিয়ে হাতে লেখা নোট পেয়েছে। লুকিয়ে রাখা এক নোটে লেখা ছিল, ‘আমি খারাপ, আমিই এ কাজ করেছি।’
যুক্তরাজ্যের ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের (সিপিএস) এক বিবৃতিতে বলা হয়, লেটবি ২০১৫ ও ২০১৬ সালের মধ্যে কাউন্টেস অব চেস্টার হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডের ১৩টি শিশুকে গোপনে হত্যার চেষ্টা চালান।
বিবৃতিতে বলা হয়, লেটবির উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের হত্যা করা। তবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সহকর্মীদের তিনি বিশ্বাস করাতেন, স্বাভাবিকভাবে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
সিপিএসের প্যাসকেল জোনস নার্স লেটবির এ কর্মকাণ্ডকে ‘পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, তাঁর ওপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকেরা যে আস্থা রেখেছিলেন, তিনি ঠিক তার উল্টো কাজ করেছেন।
প্যাসকেল জোনস বলেন, বাতাস, দুধ, ফ্লুইডসহ নিরীহ জিনিসপত্র বা ইনসুলিনের মতো ওষুধ লেটবির হাতে প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছিল। তিনি তাঁর শিক্ষার বিকৃত প্রয়োগ করেছেন এবং অন্যের ক্ষতি করতে ও মৃত্যু ঘটাতে একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ঘটনা প্রকাশ না পেলে তাঁরা কখনো হয়তো তাঁদের সন্তানের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতেন না।
যৌথ বিবৃতিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বলছে, একটি শিশুসন্তানকে হারানো কতটা কষ্টের, সেটা কেবল ভুক্তভোগী পরিবার জানে। কোনো মা–বাবার জীবনে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিশুসন্তানকে হারানো সত্যি অকল্পনীয়।
তদন্তের স্বার্থে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুবার লেটবিকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে আবার ২০২০ সালের নভেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
লেটবির বাড়ি তল্লাশিকালে পুলিশ তাঁর হাতে লেখা নোট উদ্ধার করে। একটি নোটে লেটবি লিখেছেন, ‘আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমি তাদের হত্যা করেছি। কারণ, তাদের যত্ন নেওয়ার মতো ভালো মানুষ ছিলাম না আমি।’
আরেকটি নোটে লেটবি লিখেছেন, ‘আমি ভয়ংকর খারাপ।’ বড় হাতের অক্ষরে লেখা, ‘আমি খারাপ, আমিই এই কাজ করেছি।’
পিএ মিডিয়ার খবরে বলা হয়, ‘চাইল্ড ই’ ও ‘চাইল্ড এফ’-এর মা আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলেন, তিনি লেটবির কথায় ‘পুরোপুরি’ আস্থা রেখেছিলেন।
ওই মা বলেন, এক রাতে তাঁর শিশুসন্তান চাইল্ড ই যখন চিৎকার করে কাঁদছিল, তখন তাঁর মনে হয়েছিল, ‘কিছু একটা গলদ’ হয়েছে।
ওই মা জানতে পারেন, লেটবি শিশুসন্তান ‘চাইল্ড ই’কে হত্যার আগে তার শরীর থেকে রক্তপাত হচ্ছিল। ওই সময় লেটবি তাঁর সন্তানকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছিলেন।
ওই মা আদালতকে বলেন, ‘তখন এমন শব্দ আসছিল, যা একটি নবজাতক থেকে আসার কথা নয়। শব্দটা কেমন ছিল, আমি তা ঠিক বোঝাতে পারব না। সেই শব্দ ছিল ভয়ানক। শিশুদের কান্নার চেয়ে অন্য রকম চিৎকারের শব্দ ছিল।’
ওই মা বলেন, ‘চাইল্ড ই’-এর মৃত্যুর পর তার ময়নাতদন্ত করা হয়নি। তিনিও ভেবেছিলেন, শিশুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা ক্ষুব্ধ, আমরা বিধ্বস্ত, আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে।’
২১ আগস্ট ম্যানচেস্টার ক্রাউন আদালতে লেটবির মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।