২০১৪ সালে ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার দখল নিতে রাশিয়া অভিযান শুরু করলে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় নারী স্বেচ্ছাসেবী যুদ্ধে যোগ দেন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আবার হামলা শুরু করে রাশিয়া। রুশ হামলা শুরুর পর গত এক বছরে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়তে থাকে। শুধু নারী সেনারাই নন, বেসামরিক নারীরাও প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে নারীরা কাজ করছেন। তবে ২০১৪ সালের আগপর্যন্ত এসব নারী সেনাসদস্য শুধু সহায়ক ভূমিকায় ছিলেন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় রুশ অভিযান শুরুর পর নারীরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোগ দিতে থাকেন। আর ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সব পদ নারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অবশ্য সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত অনেক নারী কর্মীকে একই রকমের ঝুঁকি নিতে হয়। সেনাবাহিনীর নারী চিকিৎসক তেমনই একটি পদ।
ইউক্রেনের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্না মালিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের গ্রীষ্ম নাগাদ ৫০ হাজারের বেশি নারী ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৩৮ হাজার নারী ইউনিফর্ম পরে দায়িত্ব পালন করছেন। নারী সেনারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন।
গত জানুয়ারির শেষের দিকে রেডিও ফ্রি ইউরোপকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সমাজকর্মী ও গবেষক আনা কিভিত বলেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনের আইন অনুযায়ী নারীদের সরাসরি যুদ্ধ করার অনুমতি ছিল না। সে কারণে স্বেচ্ছাসেবী নারী যোদ্ধারা শুধু রাঁধুনি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিংবা হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। এ আইনগত বৈষম্যের কারণে দনবাসে লড়াইকারী বেশির ভাগ নারী সামাজিক কিংবা সামরিক সুবিধা, সামরিক পুরস্কার এবং সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরির নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। তবে এখন নাগরিক সমাজের চাপ এবং নারী অধিকারকর্মীদের সোচ্চার ভূমিকার কারণে আইনি এ বৈষম্য দূর হয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত কয়েকজন নারী সদস্য আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দেন। এমনই একজন নাতালিয়া। তিনি তখন বলেন, ‘সেনাসদস্যদের সহযোগিতার জন্য আমি সম্মুখ যুদ্ধে থাকতে চাই। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের এ যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে হবে। আবার দেশে শান্তি ফেরাতে হবে। আমাদের শহরগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, নারী-পুরুষ নির্বিচার মানুষদের হত্যা করা হয়েছে। ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে।’
কাতিয়া (ছদ্মনাম) নামের ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী বলেন, তাঁর দেশে রুশ অভিযানের পর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধক্ষেত্রের চিকিৎসাকর্মী হিসেবেও প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তিনি।
কাতিয়া বলেন, ‘আমি একজন দেশপ্রেমিক। এ যুদ্ধের সময় আমি হাতগুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমি জনগণকে বাঁচাতে চাই এবং রাশিয়ার কাছ থেকে আমার দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে লড়াই করতে চাই। যেন আমার সন্তানদের কখনো এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে না হয়।’
সশস্ত্র বাহিনীতে নিযুক্ত নারী সদস্যদের যুদ্ধবন্দীও হতে হচ্ছে। ইউক্রেনীয় চিকিৎসাকর্মী ইউলিয়া পায়েভস্কাকে তিন মাস ধরে কারাবন্দী রাখা হয়েছিল। এক মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউলিয়া বলেছিলেন, বন্দী নারীদের সঙ্গে অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করা হতো।
বিভিন্ন প্রথা বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক একটি দেশ ইউক্রেন। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশটিতে নারী সেনাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগত বাড়ছে। সেনাবাহিনীতে নারীদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির একটি বড় ইঙ্গিত দেখা গেছে ২০২১ সালে। ওই বছর ন্যাশনাল ডিফেন্ডার’স ডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ডে অব মেন অ্যান্ড উইমেন ডিফেন্ডারস অব ইউক্রেন।
আরও কিছু ইঙ্গিত আছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন নিয়মিতই সেনাবাহিনীর নারী সদস্যদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে। ইউক্রেনের নারী সেনাদের নিয়ে এখন প্রায়ই খবরের শিরোনাম হতেও দেখা যায়। তাঁরা সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, সেনাবাহিনীতে তাঁদের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাচ্ছেন। ২০২২ সালের অক্টোবর নাগাদ ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে শুধু নারী কর্মকর্তাই ছিলেন আট হাজার। ইউক্রেনের একজন নারী উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রীও আছেন।
গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সেনারা সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেনের রাস্তায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করেন ইউক্রেনীয়রা। ওই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন ইউক্রেনের এক নারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট হওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ভারী অস্ত্র নিয়ে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা রুশ সেনাদের কাছে ইউক্রেনের ওই নারী জানতে চান, তাঁর দেশে কী করছেন তাঁরা। প্রথমে ওই নারী সেনাদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কারা?’ সেনাদের উত্তর, ‘আমরা এখানে মহড়া করছি। দয়া করে এদিক (সড়কের এক দিক দেখিয়ে) দিয়ে যান।’ ইউক্রেনের বন্দর নগরী হেনিচেস্কের ওই নারী যখন জানতে পারেন, তাঁরা রাশিয়ার সেনা, তখন তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘তো, তোমরা এখানে কী করছ?’
ওই নারী একটুও ভীত না হয়ে রুশ সেনাদের বলেন, ‘তোমরা দখলদার, তোমরা স্বৈরাচার। বন্দুক হাতে তোমরা আমাদের দেশে কী করছ?’ ইউক্রেনের জাতীয় ফুল সূর্যমুখী বীজ হাতে তিনি রুশ সেনাদের বলেন, ‘এসব নিয়ে পকেটে রাখো। যখন তোমরা মারা পড়বে, তখন অন্তত সূর্যমুখীর গাছ হবে।’
গত বছর মে মাসে ফ্রান্সের ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রতিবাদের একটি ঘটনা দেখা গেছে। শরীরে ইউক্রেনের পতাকা আঁকা একজন নারী কানে দেশটিতে নারীদের ধর্ষণের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ওই নারী কান চলচ্চিত্র উৎসবের লালগালিচায় অর্ধনগ্ন (টপলেস) হয়ে এই প্রতিবাদ জানান। তাঁর শরীরে রং দিয়ে লেখা ছিল ‘আমাদের ধর্ষণ বন্ধ করুন’। পরে ওই নারীকে লালগালিচা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে সাবেক অভিনেতা ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, রুশ সেনাদের হাতে ইউক্রেনের শত শত নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার তথ্য আছে তদন্তকারীদের কাছে। রুশ সেনাদের কাছ থেকে ছোট ছোট শিশুরাও রক্ষা পায়নি।
২০ ফেব্রুয়ারি মানবিক সহায়তা সংস্থা কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ৫৪ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশই নারী। এ ছাড়া ইউক্রেনের ৮০ লাখ মানুষ পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে ৮০ লাখ মানুষ আশ্রয় চেয়েছে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশই নারী।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউক্রেনে নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন ও লৈঙ্গিক সহিংসতা বেড়েছে।
আল–জাজিরা, দ্য কনভারসেশন, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল অবলম্বনে