ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়তে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা তলব করেছে রাশিয়া। তবে ক্রেমলিনের এমন সিদ্ধান্ত ধাক্কা হিসেবে এসেছে অনেক রুশ নাগরিকের জন্য। যুদ্ধে যাওয়া এড়াতে তাঁদের কেউ কেউ মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাত মাসের যুদ্ধ দেশটির বড় শহরগুলোর বাসিন্দারা টের পায়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাষণ শেষ হতে না হতেই এই যুদ্ধের আঁচ শহরবাসীরা টের পাচ্ছেন।
বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপসগুলোতে উদ্বিগ্ন আলাপের ঝড় উঠেছে—এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে। কীভাবে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানো যায়, সেই পরিকল্পনা হচ্ছে। সেন্ট পিটার্সবার্গের চাকরিজীবী ২৮ বছরের দিমিত্রি। তিনি বলেন, কর্মীরা অফিস করতে পারছেন না। সবার নজর টেলিভিশন, কম্পিউটার আর মুঠোফোনের স্ক্রিনে।
বিবিসিকে পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতেও ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। বললেন, ‘পরিস্থিতি অনেকটা আশির দশকের সায়েন্স ফিকশননির্ভর সিনেমার মতো।’ মধ্যাহ্নভোজের পর অফিস থেকে বের হয়ে যেতে দেখা যায় দিমিত্রিকে। পাশের ব্যাংকে তিনি রুবল দিয়ে ডলার কিনতে যান।
যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় পুলিশ দিমিত্রিকে খুঁজছে। পুলিশের নজর এড়াতে বাসা পাল্টে ফেলেন দিমিত্রি। ভেবেছিলেন, তাঁকে খুঁজে বের করাটা কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হবে। তিনি বলেন, ‘কী করা উচিত, ঠিক করতে পারছি না। পরের উড়োজাহাজেই কি লাফ দিয়ে চড়ে বসব নাকি রাশিয়ায় আরও কিছুদিন থেকে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে যোগ দিয়ে পুলিশের দাবড়ানি খাব।’
ইতিমধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার ডাক পড়েছে সের্গেইয়ের। আসল নাম প্রকাশে রাজি না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে তাঁর ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে। ২৬ বছর বয়সী সের্গেই রাশিয়ার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি পিএইচডির ছাত্র। পুতিনের ভাষণ দেওয়ার আগের রাতে বাসায় মুদিদোকানের হোম ডেলিভারির অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কলিং বেল বেজে ওঠার পর দরজা খুলতেই সাদা পোশাকের দুই ব্যক্তি তাঁর হাতে সামরিক কিছু কাগজপত্র ধরিয়ে দেন এবং তাতে স্বাক্ষর করতে বলেন।
বিবিসি এসব কাগজপত্রের একটি অনুলিপি পেয়েছে। এতে তাঁকে গত বৃহস্পতিবার যোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুতের কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছিল।
ক্রেমলিন বলছে, যাঁরা সামরিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন এবং যাঁদের বিশেষ দক্ষতা ও যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদেরই শুধু ডাকা হবে। কিন্তু সের্গেইর কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা নেই। এ নিয়ে তাঁর সৎবাবা চিন্তিত। কারণ, তালিকায় নাম তুলতে ফাঁকি দেওয়া রাশিয়ায় ফৌজদারি অপরাধ।
সের্গেইর সৎবাবা একটি সরকারি তেল কোম্পানিতে কাজ করেন। কয়েক ঘণ্টা পর মানবসম্পদ শাখা থেকে তাঁকে সামরিক পরিষেবা থেকে আইনি ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
সব রুশ পুরুষ এমনটা না করলেও অনেকেই যোদ্ধার খাতায় নাম তোলা এড়ানোর উপায় খুঁজছেন। মস্কোর বাসিন্দা ভিচেস্লাভ ও তাঁর বন্ধু যুদ্ধ এড়াতে নিজেকে অসুস্থ দেখানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘মাদকাসক্তির জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অথবা চিকিৎসা গ্রহণ ভালো উপায় হতে পারে; কম খরচ, এমনকি বিনা মূল্যেও পাওয়া যেতে পারে।’
তাঁর বোনজামাই অল্পের জন্য তালিকায় নাম তোলা থেকে বেঁচে গেছেন। কারণ, কর্মকর্তারা যখন বাসায় এসেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন না। তাঁর মা কাগজপত্র দেখেছেন। যদিও ১৯ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাঁকে তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
ভিচেস্লাভ বলেন, ‘তিনি এখন নিজেকে ঘরবন্দী রেখেছেন । সেখান থেকে বের হতে চাইছেন না। তাঁর তিন বছর ও এক বছরের দুই সন্তান রয়েছে। তিনি আর কী করতে পারতেন?’
যুদ্ধ এড়াতে কালিনিনগ্রাদের এক বাসিন্দা আরও মরিয়া। তিনি বলেন, যোদ্ধার তালিকায় নাম তোলা এড়াতে তিনি সবকিছু করবেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার হাত-পা ভেঙে ফেলব। কারাগারে যাব। গোটা প্রক্রিয়াটা এড়াতে সবকিছু করব।’
গত বুধবার রাতে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে হাজারো মানুষ যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ অংশ নিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই বলেছেন, তালিকায় নাম দিতে সড়কে অথবা থানায় আটক অবস্থায় তাঁদের হাতে কাগজপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন ওভিডি-ইনফো মস্কোর ১০টি থানার তালিকা করেছে। এসব এলাকায় বিক্ষোভকারীদের হাতে তালিকায় নাম তোলার কাগজপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। মস্কোর ভেরনাদস্কি এলাকায় অন্তত একজন কাগজে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।