ভ্লাদিমির পুতিন ও ভলোদিমির জেলেনস্কি
ভ্লাদিমির পুতিন ও ভলোদিমির জেলেনস্কি

অস্ত্র সরবরাহে ইউক্রেনের মিত্রদের ছাপিয়ে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠরা

চলতি বছরের মার্চে ইউক্রেন তার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে প্রতি মাসে আড়াই লাখ গোলা চায়। দেশটির তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকোভ বলেছিলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ণ মাত্রায় লড়াইয়ের জন্য তাঁদের প্রতি মাসে অন্তত সাড়ে তিন লাখ গোলা প্রয়োজন। ইউক্রেন তখন মাসে মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার গোলা পায়। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পার্থক্য গড়ার জন্য তাদের ইউরোপের সহায়তা দরকার ছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ১ বছরে ১০ লাখ গোলা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা ছিল ইউক্রেনের চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ। সেখানে নভেম্বরের শেষ নাগাদ ইইউ দিতে পেরেছে তিন লাখ গোলা। সেগুলো দেওয়া হয়েছে ইউরোপের দেশগুলোর সেনাবাহিনীর মজুত থেকে। প্রতিশ্রুতি পূরণে চার মাসে বাকি সাত লাখ গোলা তাদের সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেন, নতুন করে উৎপাদনের পরই ইউক্রেনকে গোলা সরবরাহ করা হবে।

আশ্চর্যজনকভাবে ইউরোপের মাটিতে প্রায় দুই বছর ধরে যুদ্ধ চলার পরও ইইউ সমরাস্ত্র উৎপাদন বাড়ানোর সক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি। গত ১৪ নভেম্বর ইইউর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের এক সমাবেশে জোসেফ বোরেল বলেন, ‘আজ আমরা জানতে চাই, আমরা কোথায় আছি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে উৎপাদনের (সমরাস্ত্র) গতি কেমন হবে।’

রাশিয়াও তার উৎপাদনসক্ষমতার চেয়ে বেশি গোলা বর্ষণ করছে। গত সেপ্টেম্বরে দেশটি এ জন্য উত্তর কোরিয়ার সহায়তা চায়। এর এক মাসের মধ্যে উত্তর কোরিয়া এক হাজার কনটেইনার গোলাবারুদ রাশিয়ায় পাঠায় বলে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কারবি জানিয়েছেন। এস্তোনিয়ার সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কর্নেল অ্যান্ট কিভিসেলগ বলেন, উত্তর কোরিয়ার পাঠানো গোলার পরিমাণ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ হবে। এই একই পরিমাণ গোলাবারুদ ইউক্রেনকে দিয়েছে ইইউ, তবে তা এক মাসে নয়, আট মাসে।

ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে স্যাটেলাইট আলোকচিত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, আগস্টে উত্তর কোরিয়ার মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলের রাসোন বন্দর থেকে রাশিয়ার দুনাই বন্দরে চালানগুলো যাওয়ায় বেশি পরিমাণে গোলাবারুদ পরিবহন সম্ভব হয়েছে।

ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র খোয়া যাওয়ার ঘটনা বলে দেয়, ন্যাটোর পরিকল্পনা টেকসই ছিল না।

এর বাইরে রেলপথ দিয়ে উত্তর কোরিয়া থেকে বাড়তি গোলাবারুদ নিয়ে থাকতে পারে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) বলেছে, স্যাটেলাইট আলোকচিত্র দেখা যাচ্ছে যে সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের বৈঠকের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে রেল চলাচল নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।

গ্রিসের অ্যারিস্টটেলিন ইউনিভার্সিটি অব থেসালোনিকির ইতিহাসের ইমেরিটাস অধ্যাপক ইয়োরগোস মার্গারিটিস বলেন, পশ্চিমের কাছে বিরাট বিস্ময়ের বিষয় হলো, চীনসহ বহির্বিশ্বের কাছ থেকে রাশিয়া যা চেয়েছিল, তা অর্জনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছে তারা। উত্তর কোরিয়া যে পরিমাণ গোলা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (১০ লাখ), তা বিরাট সংখ্যা। ইতিমধ্যে তারা এর ১০ ভাগের ১ ভাগ দিয়েও দিয়েছে।

এ বিষয়ে জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের ফেলো ইয়েনস বাস্তিয়ান বলেন, রাশিয়া পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ পাচ্ছে। তারা কতটা খরচ হলো, তা নিয়ে ভাবছে না। সন্দেহাতীতভাবে তারা তৃতীয় পক্ষেরও সহায়তা পাচ্ছে। ইউক্রেনের দিকে এই তিন বিষয় একই রকম হচ্ছে না।

এই সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় পাচ্ছে না ইইউ। জোসেফ বোরেলের মতে, ইইউর প্রতিরক্ষা শিল্পের ঘাটতির পেছনে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের চুক্তি বড় ভূমিকা রাখছে। চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নিয়ে যাচ্ছে এই ক্রেতারা।  

ইউক্রেনের টি–৭২ ট্যাংক থেকে ছোড়া হচ্ছে গোলা

ইউরোপের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ ছিল ত্বরিত ও অগ্রসরমাণ। গত ফেব্রুয়ারিতে তারা কামানের গোলার উৎপাদন ছয় গুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইউক্রেনকে সরবরাহের কারণে মজুতে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, তা পূরণে ইউক্রেনকে আরও বেশি গোলাবারুদ সরবরাহ এবং ভবিষ্যতের সংঘাতের জন্য মজুত বাড়াতে ওয়াশিংটন ওই সিদ্ধান্ত নেয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে হওয়া কোরীয় যুদ্ধের পর এবারই সবচেয়ে বেশি গোলার উৎপাদন বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র।

নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ১৪ হাজার ৪০০টি গোলা কেনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। এরপর তারা এই সংখ্যা বাড়িয়ে তিন গুণ করেছিল। এরপর ২০২৩ সালে পরিমাণ দ্বিগুণ করে ৯০ হাজারে নেয়।