২০১০ সাল থেকে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ বা টোরি পার্টি ১৮৩২ সালের পর এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। অবশ্য ২ মে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরাজয়ের পর ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত গতকাল ৪ জুলাইয়ের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটিই প্রমাণিত হলো। নির্বাচনে দলটির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন মন্ত্রীসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিস ট্রাসেরও পরাজয় ঘটেছে।
একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের বিরক্তি ভাব তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে ব্রেক্সিট–পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ব্যাংকের সুদহার ও ঘরভাড়া। কিন্তু সরকার এসব সমস্যায় কার্যকর কোনো সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের প্রস্থানের সিদ্ধান্ত কনজারভেটিভ পার্টি ও দেশটির জন্য ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট গণভোটের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কনজারভেটিভরা ব্রেক্সিটের বাস্তব সুবিধাগুলো জনগণের সামনে নিয়ে আসতে পারেনি। উপরন্তু যুক্তরাজ্যে তখন থেকেই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরে–বাইরে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। টেকসই নেতৃত্বের সংকটের কারণে গত ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন করতে হয়েছে। সাম্প্রতিক জরিপগুলো ইঙ্গিত করে যে ইইউতে পুনরায় যোগ দিতে ইচ্ছুক লোকের সংখ্যা এখনো ব্রেক্সিট সমর্থনকারীদের চেয়ে বেশি, যা ব্যাপকভাবে যুক্তরাজ্যের জন্য একটি অর্থনৈতিক ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়।
ফরাসি উপকূল থেকে ছোট নৌকায় করে অবৈধভাবে আসা অভিবাসন ঠেকাতে কনজারভেটিভ পার্টির কোনো পদক্ষেপ কার্যকর ফল বয়ে আনতে পারেনি। অবৈধ অভিবাসীদের রুয়ান্ডা পাঠানোর পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। বরং যুক্তরাজ্যে আসা বিদেশি ছাত্র ও কর্মীদের একের পর এক কঠিন শর্তের বেড়াজালে ফেলে অবৈধ হতে অনেকটা বাধ্য করেছে টোরি সরকার। নেট মাইগ্রেশন বছরে এক লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতিও বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি তারা। এসব পদক্ষেপের কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি, যার ফলে ভোটারদের মধ্যে হতাশা বেড়ছে।
কোভিড মহামারির শুরুতে সঠিক সময়ে লকডাউন ঘোষণা না করে সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য সাধারণ জনগণ কনজারভেটিভ পার্টিকে দায়ী করে। এ জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে একটি তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হয়েছে। লকডাউন চলাকালে ডাউনিং স্ট্রিটের পার্টির খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জনগণের ক্ষোভ বেড়ে যায় এবং জনগণ কনজারভেটিভ পার্টির ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করে।
২০১০ সালে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা (এনএইচএস) উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে। করোনা মহামারি চলাকালে ক্যানসার, হার্ট, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসুস্থতার জন্য রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয়ে সেসব রোগীদের অ্যাপয়েনমেন্ট বাতিল করে দিয়েছিল এনএইচএস। এতে অনেক রোগীকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ঘন ঘন ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার দায়ও কনজারভেটিভ পার্টির ওপরে দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
ব্রেক্সিট গণভোটের পরপরই আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষ। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবারের জন্য শেষ ইচ্ছা পূরণ করাও ক্রমে কঠিন হয়ে পড়েছিল। সমালোচকেরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে সরকারের নীতিগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ধনীদের পক্ষে ছিল এবং বৃহত্তর জনসংখ্যার অর্থনৈতিক অসুবিধা দূর করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে বরিস জনসনের পদত্যাগের পর ৪৯ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া লিস ট্রাসের মিনি বাজেট এতটাই আর্থিক অশান্তি সৃষ্টি করেছিল যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ড ইতিহাসের রেকর্ড পরিমাণ পড়ে গিয়েছিল। তাঁর সংক্ষিপ্ত মেয়াদ কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি জনগণের আস্থাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই অসন্তোষ কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থনকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে এবং তাদের নির্বাচনী পতনে অবদান রেখেছে।
সর্বশেষ পররাষ্ট্রনীতিতে মার্কিন নেতৃত্বের অনুসরণে সুনাকের নেতৃত্বাধীন টোরি সরকার ইউক্রেনকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হিংস্রতায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। এই পদক্ষেপগুলো অনেক ভোটারকে কনজারভেটিভ পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল, যার প্রমাণ গতকালের ফলাফলে উঠে এসেছে।
কনজারভেটিভ পার্টির পরাজয়ের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রথম ও একমাত্র ইংরেজি দৈনিক ডেইলি ডেজলিং ডন–এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রকাশক মুনজের আহমদ চৌধুরী বলেন, কনজারভেটিভ টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকায় ভোটারদের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। লেবার পার্টি বা দলটির নেতা অনেক ক্ষেত্রে এককভাবে দেশজুড়ে জনপ্রিয় না হলেও মানুষ কনজারভেটিভের বিকল্প বড় দল হিসেবে লেবারকে ভোট দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে উগ্র ডানপন্থার যে উত্থান, সেটিও কনজারভেটিভের এ বিপর্যয়ের বড় কারণ। কনজারভেটিভের একটি ভোটারশ্রেণি ডান থেকে নাইজেল ফারাজের উগ্র ডানপন্থায় ঝুঁকে গেছে। এবার আটবারের চেষ্টায় নাইজেল প্রথমবার এমপি হতে পেরেছেন, তাঁর দল সামগ্রিকভাবে দেশজুড়ে উল্লেখযোগ্য ভোট ও চারটি আসন পেয়েছে। এ ভোটগুলো কনজারভেটিভের।
ডেগেনহাম ও রেইনহাম শাখা কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান মাহদি বলেন, ব্রেক্সিট-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা, করোনা মহামারি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব পড়েছে যুক্তরাজ্যের ওপর। যার কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়েছে। ফলস্বরূপ, দেশটি ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, সংকুচিত পরিবারের বাজেট এবং বাসস্থানের দামে আকাশ ছুঁয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টি এই আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য লড়াই করেছিল কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যাপক অর্থনৈতিক অসন্তোষ কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন হ্রাস করে, তাদের নির্বাচনী পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।