রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ভীষণ চাপের মধ্যে আছেন ইউক্রেনীয় সেনারা
রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ভীষণ চাপের মধ্যে আছেন ইউক্রেনীয় সেনারা

রাশিয়ার কুরস্কে যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় সেনারা ক্লান্ত, ট্রাম্পের জন্য অপেক্ষায় তাঁরা

আবহটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, হতাশাজনক, এমনকি বিক্ষুব্ধও।

রাশিয়ার সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলে যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় এক সেনা বলেন, পরিস্থিতি প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে।

কুরস্কে অবস্থানরত আরেক ইউক্রেনীয় সেনা বলেন, এখানে লড়াইয়ের কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা যেখানে লড়ছেন, সেই ভূখণ্ড ইউক্রেনের নয়, রাশিয়ার।

প্রায় চার মাস আগে সীমান্তবর্তী রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইউক্রেন। তারা কুরস্কের একটা অংশ দখল করে নেয়।

কুরস্কের দখল করা এলাকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ইউক্রেনীয় সেনারা এখন লড়ছেন। যদিও সম্প্রতি তাঁরা কুরস্কের ৪০ শতাংশ এলাকার দখল হারিয়েছেন বলে খবর বের হয়েছে।

কুরস্কে থাকা ইউক্রেনীয় সেনারা বিবিসিকে বলেন, তাঁরা খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের (রাশিয়া) দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। অন্যদিকে সামনে যে কোনো আশা আছে, তেমনটাও দেখা যাচ্ছে না।

কুরস্কে যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিবিসি। তাঁরা যে বার্তা বিবিসিকে দিয়েছেন, তাতে হতাশার চিত্র ফুটে উঠেছে।

ইউক্রেনীয় সেনারা জানান, তাঁরা ঠিক কী উদ্দেশ্যে কুরস্কে লড়ছেন, তা বুঝতে পারছেন না।

ইউক্রেনীয় সেনারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, তাঁরা এই লড়াইয়ে হেরে যেতে পারেন।

কুরস্কে কর্মরত বেশ কয়েকজন ইউক্রেনীয় সেনার সঙ্গে টেলিগ্রামের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় বিবিসির। তাঁদের একজন অবশ্য সম্প্রতি কুরস্ক থেকে দেশে চলে গেছেন।

ইউক্রেনীয় এই সেনারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাই প্রতিবেদনে তাঁদের ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে বিবিসি।

কুরস্কে যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় সেনারা অঞ্চলটিতে বিরাজমান ভয়ানক প্রতিকূল আবহাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন পরিস্থিতি তো আছেই, পাশাপাশি তাঁরা প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গেও লড়ছেন।

ইউক্রেনীয় সেনাদের হঠাতে রাশিয়া কুরস্কে ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে চলছে। ইউক্রেনীয় সেনারা বলেন, রাশিয়া ভয়ংকর তিন হাজার কেজির গ্লাইড বোমাও ব্যবহার করছে কুরস্কে।

ইউক্রেনীয় সেনারা জানান, তাঁরা ঠিক কী উদ্দেশ্যে কুরস্কে লড়ছেন, তা বুঝতে পারছেন না

রাশিয়ার ক্রমাগত বোমাবর্ষণের কারণে ইউক্রেনীয় সেনারা ঘুমাতে পর্যন্ত পারছেন না।

রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেনীয় সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁরা স্বীকার করেন, রুশ বাহিনী ধীরে ধীরে ইউক্রেনীয় সেনাদের দখল করা অঞ্চল পুনরুদ্ধার করছে।

গত ২৬ নভেম্বর পাভলো (ছদ্মনাম) নামের এক ইউক্রেনীয় সেনা বিবিসিকে বলেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলেই তাঁর ধারণা। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনীয় সেনাদের কুরস্কের দখল করা এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারানোটা সময়ের ব্যাপারমাত্র।

পাভলো ইউক্রেনীয় সেনাদের ভীষণ ক্লান্তির কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, ইউক্রেনীয় সেনাদের পালাবদল করে দায়িত্বপালনের সুযোগ কুরস্কে কম। এর ফলে বিরামহীন ক্লান্তি ইউক্রেনীয় সেনাদের চেপে ধরেছে।

পাভলো জানান, কুরস্কে নতুন যেসব সেনা ইউনিট ইউক্রেন মোতায়েন করছে, তা মূলত মাঝবয়সী পুরুষদের নিয়ে গঠিত। এই ইউনিটগুলো অন্য কোনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি কুরস্কে পাঠানো হয়েছে। কুরস্কে এসেই তাঁদের লড়তে হচ্ছে। এর ফলে ইউক্রেনীয় সেনাদের বিশ্রামের সুযোগ নেই।

রাশিয়ার হামলার মুখে কুরস্কে ইউক্রেনীয় সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন

কমান্ডিং অফিসার, তাঁদের আদেশ-নির্দেশ, যুদ্ধ সরঞ্জামসহ অন্যান্য বিষয়ের অভাব নিয়ে ইউক্রেনীয় সেনাদের নানা অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভাব-অভিযোগের কথা শোনা হচ্ছে না বলে জানান ইউক্রেনীয় সেনারা।

কুরস্কে থাকা ইউক্রেনীয় সেনারা বিবিসিকে বলেন, তাঁরা খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের (রাশিয়া) দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। অন্যদিকে সামনে যে কোনো আশা আছে, তেমনটাও দেখা যাচ্ছে না।

ইউক্রেনীয় সেনাদের কাছ থেকে বিবিসি যে বার্তা পেয়েছে, তাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন, হতাশার চিত্র মেলে। লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউক্রেনীয় সেনাদের মধ্যে প্রেরণার অভাব থাকার বিষয়টি এসব বার্তায় ফুটে ওঠে।

কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, কুরস্কে কিয়েভের অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্যগুলোর একটি হলো ইউক্রেনের পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনাদের সরে যেতে বাধ্য করা। কিন্তু এই পরিকল্পনা আদৌ কাজ করছে কি না, তা নিয়ে ইউক্রেনীয় সেনাদের মধ্যে সন্দেহ আছে।

ইউক্রেনীয় সেনারা বলেন, এখন কিয়েভের নির্দেশ হলো, রুশ ভূখণ্ডের এই ছোট অংশটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখা।

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ট্রাম্প জয়ী হন। তিনি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে হারান।

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের নীতি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই যুদ্ধ থামাবেন তিনি।

আগামী ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন ট্রাম্প। ইউক্রেনীয় সেনা পাভলো বলেন, এখন তাঁদের সামনে প্রধান কাজ হলো ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ এবং নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত কুরস্কের সর্বাধিক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা। পরে কিছুর বিনিময়ে তা ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু কেউ জানেন না, সেটা কী।

গত মাসের (নভেম্বর) শেষ দিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দেন, মার্কিন প্রশাসনে পরিবর্তনের বিষয়টি এখন যুদ্ধের উভয় পক্ষের (কিয়েভ ও মস্কো) মাথায় রয়েছে। তিনি নিশ্চিত যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে ইউক্রেনকে রাশিয়ার অঞ্চল (কুরস্ক) থেকে হটিয়ে দিতে চান।

কুরস্কে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ করে দিতে সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সম্প্রতি একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পদক্ষেপ নিয়েছে। রাশিয়ার অভ্যন্তরের লক্ষ্যবস্তুতে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা দূরপাল্লার অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে তারা কিয়েভকে অনুমতি দিয়েছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কাছ থেকে এই অনুমতি পেয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরের লক্ষ্যবস্তুতে দূরপাল্লার অস্ত্র দিয়ে হামলা শুরু করে ইউক্রেন।

কিন্তু কিয়েভের এমন হামলা যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় সেনাদের মনোবল বাড়াতে খুব বেশি কাজে দিচ্ছে বলে মনে হয় না।

কুরস্কে যুদ্ধরত ইউক্রেনীয় সেনা পাভলো বলছিলেন, তাঁরা কেউ ঠান্ডা পরিখার মধ্যে বসে এই প্রার্থনা করছেন না যে ইউক্রেন থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে এসে যুদ্ধে তাঁদের সহায়তা করবে। কেননা, তাঁরা কুরস্কে অবস্থান করে লড়াই করছেন। আর ইউক্রেন থেকে ছোড়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে গিয়ে রাশিয়ার অন্যত্র পড়ে।