রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে প্রাধান্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে শুরু হয়েছে তিন দিনের পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ৭৫তম শীর্ষ সম্মেলন। ওয়াশিংটন ডিসির রোনাল্ড রিগ্যান ইনস্টিটিউটে গত মঙ্গলবার সম্মেলন শুরু হয়। এই ইনস্টিটিউটেই ১৯৪৯ সালে দ্য নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) যাত্রা শুরু করেছিল। এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে থামানো ও ইউক্রেনকে সহযোগিতার কথা বলেন। এ ছাড়া এ সম্মেলনে ন্যাটোর নেতারা প্রতিরক্ষা, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ও পশ্চিমা বিশ্বে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করেন।
বাইডেন বলেছেন, পুতিন ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে, ইউক্রেনের গণতন্ত্রকে শেষ করতে ও ইউক্রেনের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চান। তিনি দেশটিকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চান। আপনারা জানেন, পুতিন কিন্তু ইউক্রেনে থামবেন না। কাজেই কোনো ভুল করা যাবে না। ইউক্রেনই পুতিনকে থামাতে পারে এবং দেশটি তা করবেই। বাইডেন পুতিনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে ন্যাটোর প্রতি আহ্বান জানান।
ন্যাটোর এই সম্মেলন বাইডেনের রাজনৈতিক জীবনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত ২৭ জুন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম নির্বাচনী বিতর্কে ভালো করতে না পারায় তিনি চাপে আছেন।
এই পরিস্থিতিতে ন্যাটোর সম্মেলনে ইউরোপীয় মিত্রদের নেতাদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করার দরকার ছিল বাইডেনের। তিনি তা মোটামুটি ভালোভাবেই পেরেছেন। এ দিন বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি থেমে যাননি। বড় ধরনের তেমন কোনো ভুলও করেননি।
ন্যাটো বর্তমানে আগের চেয়ে শক্তিশালী উল্লেখ করে বাইডেন বলেন, আমেরিকার উভয় দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতা ও সিনেটর মনে করেন, ‘ন্যাটো আমাদের আগের চেয়ে নিরাপদে রেখেছে। ন্যাটো না থাকলে কী হতে পারে, তা আমেরিকার জনগণ জানে।’
সামরিক জোটটির ৩২ সদস্যের মধ্যে ২৩টি দেশ নিজেদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে পারছে বলেও জানান বাইডেন।
বক্তৃতার একপর্যায়ে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, রোমানিয়া ও ইতালির সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও কয়েক ডজন কৌশলগত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাঠাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে কিয়েভের জন্য নতুন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়ার ঘোষণা দেন বাইডেন।
এদিকে সম্মেলনের দিনই রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে লক্ষ্য করে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ১২ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া কিয়েভে একটি শিশু হাসপাতালে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাইডেন। এর বাইরে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নেতাদেরও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। উদীয়মান চীনকে রুখতে ন্যাটোর ভূমিকা বৃদ্ধিতে তিনি এ পদক্ষেপ নিয়েছেন।
কিন্তু বাইডেনকে নিজের দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়েছে। ট্রাম্প ন্যাটোর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি ইউক্রেনকে শান্তি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার কথাও বলেছেন।
ওয়াশিংটন পৌঁছে জেলেনস্কি তাঁর দেশকে সমর্থন ও নতুন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানান। এ ছাড়া রাশিয়াকে হারাতে অন্য দেশগুলোর কাছে সহযোগিতা চান তিনি। ন্যাটোর বিদায়ী মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ মার্কিন কংগ্রেসে ট্রাম্পের মিত্রদের কাছে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহে বিলম্বের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন অসাধারণ সাহস দেখিয়েছে এবং ন্যাটোর মিত্ররা অভূতপূর্ব সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের পক্ষ থেকে প্রকৃত সহযোগিতা ইউক্রেনকে করা হয়নি। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া ইউক্রেনে জিতলে সবচেয়ে বড় মূল্য চোকাতে হবে এবং সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হবে। আমরা তা হতে দিতে পারি না।’
সম্মেলনে অংশ নেওয়া অন্য নেতারা হচ্ছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবান। তিনি পুতিনের পশ্চিমা মিত্র হিসেবে পরিচিত। ওয়াশিংটনে আসার আগে তিনি ইউক্রেন, রাশিয়া ও চীন সফর করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অংশীদারদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি ন্যাটো সম্মেলনে আসার আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে এসেছেন। গতকাল বুধবার ন্যাটোর সম্মেলন শেষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন অতিথিদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। এবারের সম্মেলনে নতুন নেতা হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।
এবারের সম্মেলনে ন্যাটোর নেতাদের কাছ থেকে এ জোটে যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি চাইছেন জেলেনস্কি। এতে যুক্ত হলে সদস্যদেশগুলো নিরাপত্তা পেতে পারে। কারণ, ন্যাটোর কোনো একটি সদস্য আক্রান্ত হলে অন্য দেশগুলো নিজেদের আক্রমণ হিসেবে মনে করে। ন্যাটো জোটে ইউক্রেনকে যুক্ত করার বিষয়টি বাল্টিক ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সমর্থন পেলেও যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি এর বিরোধিতা করে আসছে। তারা মনে করছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করলে তা হবে পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো।