আল-জাজিরার বিশ্লেষণ

যুক্তরাজ্যের হাল ধরতে কতটা যোগ্য সুনাক

ঋষি সুনাক
 রয়টার্স ফাইল ছবি

কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন নিয়ে যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ঋষি সুনাক। নতুন নেতা হিসেবে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া প্রথম বক্তব্যে ৪২ বছরের সুনাক বলেন, ‘আমি যে দলকে ভালোবাসি, সে দলের জন্য ও দেশের জন্য কাজ করতে পারা আমার ঋণ শোধের সুযোগ।’

সুনাক এই সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সুনাককে নিয়ে বিশ্লেষকদের ভাবনাও তুলে ধরা হয়েছে।  

যেভাবে এলেন সুনাক

সুনাকই যুক্তরাজ্যের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী। মাত্র দুই মাস আগে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় ট্রাসের কাছে হেরে যান সুনাক। ছয় সপ্তাহ ধরে নানা আলোচনা ও সমালোচনার পর লিজ ট্রাস গত সপ্তাহে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর সুনাকই হতে যাচ্ছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।

গতকাল সোমবার প্রতিদ্বন্দ্বী পেনি মরড্যান্ট টোরি নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ান। ট্রাসের পূর্বসূরি বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে আসা নিয়ে গুঞ্জন থাকলেও গত রোববার সন্ধ্যায় বরিস নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান।

সুনাক কে

ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনাক যুক্তরাজ্যের অন্যতম সম্পদশালী রাজনীতিবিদ। যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির সাউদাম্পটন শহরে তাঁর জন্ম। ২০১৫ সালে পার্লামেন্টে প্রবেশের আগে সুনাক মার্কিন বহুজাতিক ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসে কাজ করতেন। তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি ভারতের অন্যতম ধনী তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তার মেয়ে। অক্ষতার সঙ্গে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন সুনাক।

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০২০ সালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সুনাকের নাম ঘোষণা করেন। এর পর থেকেই পরিচিতি লাভ করেন সুনাক।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের বন্দোবস্ত করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সুনাক। এর মধ্যে ছিল প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার কারণে কর্মীদের সাময়িক ছুটি, পিছিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ বরাদ্দ, রেস্তোরাঁ পরিদর্শনের জন্য ভাউচারের মতো ব্যবস্থা।

সুনাককে নিয়ে কী বলছেন বিশ্লেষকেরা

যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি অধ্যাপক নেইল কার্টার আল-জাজিরাকে বলেছেন, সুনাক এমন একজন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কাজ করেছিলেন, যিনি অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে ইঙ্গিত করে নেইল বলেন, তিনি অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে ব্যয় করতে আগ্রহী ছিলেন। সমতা আনার অ্যাজেন্ডা নিয়েছিলেন। কিন্তু কীভাবে ব্যয় করবেন, তা বিবেচনা না করেই ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

নেইল কার্টার আরও বলেন, বরিসের নেওয়া পদক্ষেপে কিছু ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়েছে। যেমন খাওয়ার জন্য ভাউচার কর্মসূচি রেস্তোরাঁ খাতকে বাঁচিয়েছে। তবে ২০২০ সালে শরৎ মৌসুমে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এর ধ্বংসাত্মক ভূমিকা ছিল।

ব্রিটিশ রাজনীতির বিশ্লেষক স্টিফেন এলসটাব আল-জাজিরাকে বলেছেন, জনসনই সুনাককে দিয়ে ভুল কাজটি করিয়েছেন। তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় সরকার নিয়মিত টিভিতে ব্রিফিং করেছে। সে সময় চ্যান্সেলর সরকারের হ্যান্ডআউটের ঘোষণা দিয়েছেন। সেসব হ্যান্ডআউটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী করোনায় কতজন মারা গেছেন এবং আমাদের সবাইকে ঘরে থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন।
এ বছর লকডাউন শেষ হওয়ার পর সুনাক সরকারি ঋণ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সে সময় ব্রিটেনের জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে।

নেইল কার্টার আরও বলেছেন, করপোরেশন কর ও জাতীয় বিমা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর ফলে ব্যবসা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় বিমা শ্রমিকদের জন্য কর। আর এর বোঝা তরুণ কর্মীদের ওপর পড়েছিল।
সুনাক তাঁর পূর্বসূরির করনীতির কড়া সমালোচনা করেছিলেন। সুনাক বলেছিলেন, এতে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। সুনাক এমনও বলেন, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির হাল ধরার জন্য তিনিই সঠিক ব্যক্তি।

সুনাককে যা করতে হবে

জনমত জরিপে ব্যাপক ব্যবধানে এগিয়ে থাকা যুক্তরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা কেয়ার স্টার্মার গত সপ্তাহে বলেছেন, তিনি সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুত। টুইটে তিনি বলেন, টোরিদের ব্যর্থতার ১২ বছর পর ব্রিটিশ জনগণের ভালো কিছু প্রাপ্য রয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুনাকের ম্যান্ডেটের অভাবের অর্থ হলো, তাঁকে অবিলম্বে চোখে পড়ার মতো কিছু সাফল্য দেখাতে হবে।

নটিংহাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির শিক্ষক টম কেগিল বলেছেন বেশ কিছু সমস্যা সুনাকের টেবিলে তাঁর অপেক্ষায় আছে। আল-জাজিরাকে এসব সমস্যার ব্যাখ্যা দেন কেগিল। তিনি বলেন, ট্রাসের ছোট বাজেটের প্রভাব এখনো আছে। অর্থবাজার স্থিতিশীলতার পথ খুঁজছে। বাজার কিছু আর্থিক নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাশা করছে। তবে এই নিয়ন্ত্রণের জন্য কর বাড়াতে হবে অথবা খরচ কমাতে হবে। আর এর কোনোটাই জনপ্রিয় হবে না।

টম কেগিল আরও বলছেন, সুনাককে বিভক্ত একটি দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এ জন্য সময় লাগবে। খুব তাড়াতাড়ি এ কাজ করা যাবে না।

সুনাকের প্রতি আবার অনেক টোরির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। জনসনের পতনের জন্য অনেকে সুনাকের বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ী করেন। টোরি নেতা নির্বাচনের প্রতিযোগিতায় এর আগে ট্রাস সুনাককে ৬০ হাজার ৩৯৯ থেকে ৮১ হাজার ৩২৬ ভোটে পরাজিত করেন।

সুনাক যুক্তরাজ্যের টালমাটাল অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও রাজনীতিতে ঐক্য আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কেগিল বলছেন, তিনি আগাম নির্বাচন আশা করেন না। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচন করা সম্ভব নয়। পরাজিত হওয়ার আশঙ্কায় কনজারভেটিভ পার্টি আগাম নির্বাচন দেবে না।
স্ট্রেচক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির শিক্ষক মার্ক শেফার্ড বলেছেন, আগাম নির্বাচন কখন হবে, তা নির্ভর করে সুনাক তাঁর দলে কতটা সমর্থন পাবেন, তার ওপর। শেফার্ড বলছেন, দল ঐক্যবদ্ধ না হলে সরকার গঠন অসম্ভব। দলের জয়েরও সম্ভাবনা নেই।

সুনাকের সমর্থকেরা বলছেন, তিনি বারবার অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে ট্রাসকে সতর্ক করেছিলেন। সমর্থকেরা এই প্রচার চালিয়ে এটা প্রমাণ করতে চাইছেন যে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার লাগাম টেনে ধরতে সুনাকই যোগ্য ব্যক্তি।

শেফার্ড বলছেন, সুনাক এ ক্ষেত্রে কতটা সফল হবেন, তা সময় বলে দেবে। সুনাকের জয়ের পর ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দর শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এটিও একটি ইতিবাচক দিক।
এলসটাব বলছেন, সুনাক ব্রেক্সিটপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী। সুনাক কম করের পক্ষে। এসব কারণে দল তাঁর পক্ষে থাকবে। সুনাক খুবই বাস্তববাদী বলছেন এলসটাব।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুনাককে নজরে পড়ার মতো করে দলে ঐক্য আনতে হবে। সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে টালমাটাল যুক্তরাজ্যে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। তা না হলে তাঁর মেয়াদ সীমিত হতে পারে।