আত্মঘাতী বাজি ধরলেন পুতিন

রাশিয়ার নভগোরদ অঞ্চলের গভর্নর আন্দ্রেই নিকিতিনের সঙ্গে বৈঠক করছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ভেলিকি নভগোরদ, ২১ সেপ্টেম্বর
 ছবি: রয়টার্স

২১ সেপ্টেম্বর ২০২২। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে তাঁর দেশের যুদ্ধ নিয়ে ধরা বাজিকে এক বিপজ্জনক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। ঘোষণা করলেন, আংশিক সেনা সমাবেশের; হুমকি দিলেন দেশের ভূখণ্ড রক্ষায় প্রয়োজনে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে এদিন (গত বুধবার) পুতিন বলেন, ‘এটা কোনো ধাপ্পাবাজি নয়। যারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আমাদের ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করছে, তাদের এটা জেনে রাখা উচিত, হাওয়া তাদের দিকে ঘুরে যেতে পারে।’

পুতিনের ভাষণের পর রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শইগু বলেন, আংশিক সেনা সমাবেশের অধীন প্রায় তিন লাখ রিজার্ভ সেনা ডাকা হবে। তবে প্রকৃত সংখ্যা হতে পারে অনেক বেশি। প্রেসিডেন্টের এ–সংক্রান্ত ডিক্রি জনসমক্ষে পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি। যে আংশিক প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রিজার্ভ সেনা নিয়ে প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রার উল্লেখ নেই। অস্পষ্ট কিছু শব্দচয়ন ছাড়া সেনা সমাবেশের শর্তাবলিরও উল্লেখ নেই। রাশিয়ার নিরপেক্ষ ধারার পত্রিকা নোভায়া গেজেটা ক্রেমলিনের এক সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছে, ডিক্রির অপ্রকাশিত একটি ধারায় এ সংখ্যা বলা হয়েছে এক মিলিয়ন (১০ লাখ)। অবশ্য ক্রেমলিন এ খবর নাকচ করে দিয়েছে।

যুগপৎভাবে, রাশিয়া ইউক্রেনের আংশিকভাবে দখল করা চারটি অঞ্চলে ‘গণভোট’ আয়োজন করেছে। শুক্রবার রাশিয়া এ অঞ্চলগুলোকে তার অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণা ক্রেমলিনকে এমন দাবি করারও সুযোগ করে দেবে যে ইউক্রেন ‘রাশিয়ার ভূখণ্ডে’ হামলা চালাচ্ছে। তা হলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষানীতি দেশটিকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও অনুমোদন দেবে।

ভয়ানক এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেন যুদ্ধের গতি–প্রকৃতি ও রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা অনুমান করা খুবই কঠিন।

পুতিন এক খেপাটে ঝুঁকি নিচ্ছেন। এটি তাঁর শাসনের অবসান ঘটাতে পারে—ঠিক যেমনটি পারে ইউক্রেনকে রক্তের সাগরে ডুবিয়ে দিতে ও বৃহৎ পরিসরে এবং চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিকে পরাজিত করতে।

পুতিন এক খ্যাপাটে ঝুঁকি নিচ্ছেন। এটি তাঁর শাসনের অবসান ঘটাতে পারে। ঠিক যেমনটি পারে, ইউক্রেনকে রক্তের সাগরে ডুবিয়ে দিতে ও বৃহৎ পরিসরে, চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিকে পরাজিত করতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়ায় গণসেনা সমাবেশের ঘটনা আর ঘটেনি। নতুন করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুগত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পুতিন সরকারের সামাজিক চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। নিজেদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিনিময়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে ছাড় দিয়েছেন তাঁরা।

পুতিনের শাসনামলে রাশিয়ার নাগরিকেরা রাজনীতি থেকে নিজেদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। জনগণের দরজায় রাজনীতির কড়া না নাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সরকারও। পুতিন তাঁর বিরোধীদের লক্ষ্য করে নির্ভুল আক্রমণ চালানোর বিষয়ে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দমন–পীড়ন জনগণের ক্ষুদ্র একটা অংশকেই শুধু প্রভাবিত করেছে; যারা সক্রিয়ভাবে পুতিনের বিরোধিতায় অংশ নিয়েছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর মরিয়া নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই রাশিয়ার নাগরিকেরা স্মরণকালের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করছেন। নব্বইয়ের দশকে উদারনৈতিক সংস্কারের যুগে জনগণ যে হতাশার সম্মুখীন হন, সেই অবস্থা থেকেও জনগণ এখন অনেক দূরে।

কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী সেনা সমাবেশ এগিয়ে গেলে লাখ লাখ মানুষ সরাসরি ও মর্মান্তিকভাবে পুতিনের আত্মঘাতী পররাষ্ট্রনীতির শিকার হবেন। তাঁরা শর্তসাপেক্ষে ও অনিচ্ছা সত্ত্বেই শুধু তা মেনে নেবেন।

বিংশ শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে দেশপ্রেমের যে উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, সেই অবস্থার সঙ্গে বর্তমান রাশিয়ার ছিটেফোঁটা মিল নেই। বরং দেশ ছেড়ে পালাতে রাশিয়ার সীমান্তে লোকজনের এখন দীর্ঘ লাইন; উচ্চমূল্যে বিমান টিকিট কিনতেও মানুষের ভিড়।

কেন এই ঝুঁকি নিচ্ছেন পুতিন

জনগণকে নিজের দুঃসাহসী পররাষ্ট্রনীতি থেকে সুরক্ষায় পুতিনের অনুসৃত নীতির শিকড় গেঁথে আছে রাশিয়ার স্থিতিশীলতার ভেতরে। তাঁর ক্ষমতার প্রথম দশকে এই স্থিতিশীলতাই তাঁকে সমর্থন জুগিয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকের বিশৃঙ্খলার অভিজ্ঞতার পর রাশিয়ার সমাজ পুতিনের শাসনামলের স্থিতিশীলতাকে সর্বান্তঃকরণে স্বাগত জানিয়েছে। আর এটি ছিল তাঁর কর্তৃত্বের বৈধতার উৎস। কিন্তু বছর দশেক আগে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এক প্রতিবাদ–বিক্ষোভ তাঁর শাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

ওই সময় থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে নিজের বিরোধকে তাঁর শাসনক্ষমতার বৈধতার নতুন উৎস বানিয়ে ফেলেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জনপ্রিয় নেতা থেকে একজন যুদ্ধকালীন একনায়ক হয়ে ওঠেন তিনি।

রাশিয়ার নিরপেক্ষ ধারার পত্রিকা নোভায়া গেজেটা ক্রেমলিনের এক সূত্রের বরাতে বলেছে, ডিক্রির অপ্রকাশিত একটি ধারায় সেনা সমাবেশের সংখ্যা বলা হয়েছে এক মিলিয়ন (১০ লাখ)। অবশ্য ক্রেমলিন এ খবর নাকচ করে দিয়েছে।

ক্ষমতায় টিকে থাকতে দেশের জনগণের মধ্যে পশ্চিমাদের তরফে প্রকৃত হুমকির বোধ জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাঁর। এ হুমকিকে বাস্তবে রূপ দেওয়াও তাঁর জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রাশিয়াকে ভূরাজনৈতিকভাবে একঘরে করে পশ্চিমা দেশগুলোও দেশটির নাগরিকদের একটা গণতান্ত্রিক ইউরোপীয় বিকল্প পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে।
এখন প্রেসিডেন্ট পুতিন জনগণের একটি বড় অংশকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন, যেখানে ব্যক্তিগতভাবে বাঁচতে হলেও তাঁদের লড়াই করতে হবে। এতে তাঁর শাসনও দেশের ভেতর থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে পারে। তবে নানা সুযোগ তাঁকে এই ঝুঁকি উতরে যেতে সম্ভবত সহায়তা করবে।

এটি বিশ্বাস করা অযৌক্তিক হবে, ইউক্রেন যুদ্ধকে পুতিন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে না পারলে নাগরিক অসন্তোষ তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। কেননা যখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দিকেই জনগণের নজর বেশি থাকে, তখন বিপ্লবী হয়ে ওঠার চিন্তা তাঁদের জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে। কোনো যুদ্ধ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার পরিবর্তে একে আরও ম্লান করে। এ কারণেই পুতিন যুদ্ধ শুরু করেছিলেন সেই ২০১৪ সালে (ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে)। এর মধ্য দিয়ে তিনি অভ্যন্তরীণ সংঘাত প্রতিবেশী দেশে ঢুকিয়ে দেন।

প্রথমবারের মতো বিপ্লব করায় ক্রিমিয়া দখলে নিয়ে ইউক্রেনকে শায়েস্তা করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। এটি দেশটির রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য সতর্কতামূলক এক গল্পের মতো। রাশিয়ার সেনারা মারিয়াপোল ও খারকিভের মতো রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলগুলোতে চষে বেড়ানোর সময় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন যে ইউক্রেনবাসীর মতো বিদ্রোহ করলে তাঁদের পরিণতিও হতে পারে একই রকম।

নিশ্চয়ই, উৎসাহ–উদ্দীপনা না পেলে নতুন নিযুক্তির আওতায় আসা সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ বা ইউক্রেনে গণহারে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। এই সম্ভাবনা বাড়বে, যদি কমান্ডারদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ না দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে পাঠানো হয় বা ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে রাশিয়া লজ্জাজনক পরাজয়বরণ করে।

তবে বাস্তবতা হলো, নতুন সেনা সমাবেশে বিশেষভাবে নিশানা করা হচ্ছে স্বল্পশিক্ষিত ও তুলনামূলকভাবে কম সচ্ছল শ্রেণির নাগরিকদের। এতে উল্লিখিত দৃশ্যের অবতারণা হওয়ার সম্ভাবনা কমই রয়েছে। কে বিদ্রোহের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলবেন, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। উগ্র জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা এরই মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা ও উদারনীতি গ্রহণের অভিযোগে পুতিনের ওপর খেপেছেন। মধ্যপন্থীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন তাঁরা। তেমন ক্ষেত্রে পুতিন নিজেকে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ মনে করলে, শেষ অবলম্বন হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন তিনি। চূড়ান্ত পর্যায়ের সে সম্ভাবনাও রয়েছে।

এমনটাও হতে পারে, সেনা সমাবেশের মধ্য দিয়ে পুতিন তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য—সামরিক বিজয় অর্জন করবেন। ওই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন মিনস্ক চুক্তির চেয়েও অপমানজনক শান্তিচুক্তিতে সই করতে বাধ্য হবে। রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মিনস্ক চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল ইউক্রেন। আবারও এমন কোনো পরিস্থিতিতে রাশিয়ায় পুতিন হয়ে উঠবেন নতুন করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ইউক্রেন জয় তাঁর এ ক্ষমতাকে যেমন বৈধতা দেবে, তেমন নিশ্চিতভাবে দীর্ঘায়িতও  করবে।