আল–জাজিরার বিশ্লেষণ

খেরসনে রাশিয়া কি ফাঁদ পেতেছে

ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর আগে দেশটির খেরসন অঞ্চলে ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষণ মহড়া
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে হামলা শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই খেরসন অঞ্চল দখল করেছিলেন রাশিয়ার সেনারা। এরপর সেখানে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে মস্কো। সম্প্রতি খেরসনকে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে অঙ্গীভূত করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিভিন্ন কারণে এই অঞ্চলটি দখলে রাখা মস্কোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

খেরসনের অবস্থান নিপার নদীর তীরে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপ থেকে ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগের একটি পথ হিসেবে কাজ করছে অঞ্চলটি। আর নিপার নদীর পশ্চিম তীরের বড় একটি অংশ রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেখান থেকে ইউক্রেনের উত্তর ও পশ্চিমে আরও অঞ্চল দখলে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে তাদের।

তবে বিগত কয়েক সপ্তাহে খেরসনে হোঁচট খেতে দেখা গেছে রুশ সেনাদের। নিপার নদীর পশ্চিম তীরে তাদের হাত থেকে বেশ কয়েকটি শহর ও গ্রাম মুক্ত করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ওই এলাকার কয়েকটি সেতু ধ্বংস করা হয়েছে। হামলা হয়েছে নিপার নদীর কয়েকটি ফেরি ও পন্টুনে।

খেরসনে মস্কোর নিয়োগ করা প্রশাসন জানিয়েছে, ইউক্রনের হামলা থেকে বাঁচতে নিপার নদীর পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার বাসিন্দা নিরাপদে সরে গেছেন। রাশিয়ার যে কোনো স্থানে তাঁদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করা হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

নিপার নদীর পশ্চিম তীর থেকে পূর্বে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নেওয়াটা আগে থেকে পরিকল্পনা করা। এ নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সত্যটা হলো, লোকজন জড়ো করে রুশ বাহিনী সেখানে শক্তি বাড়াচ্ছে। ইউক্রেনীয়দের ওপর পাল্টা হামলা চালাতে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইহর রোমানেঙ্কো, সাবেক উপপ্রধান, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী

খেরসনের বাসিন্দাদের সফলভাবে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলেন ক্রিমিয়ার প্রশাসনিক প্রধান সের্গেই আক্সিওনভ। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর গোলা হামলার শিকার এলাকাগুলো থেকে যাঁরা স্বেচ্ছায় এবং নিরাপদে সরে যেতে চাচ্ছিলেন, তাঁরা তা করতে পেরেছেন। এ খবরে আমি আনন্দিত।’

গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, খেরসন ও নোভা কাখোভকা শহরে দুর্গ নির্মাণসহ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। শহর দুটির অবস্থান নোভা কাখোভকা বাঁধের কাছেই।

এরই মধ্যে ক্রেমলিনপন্থী একটি গণমাধ্যম জানায়, খেরসন থেকে রাশিয়ার কিছু সেনাকেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে করে তাঁরা অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা রুশ কমান্ডারদের বিশালাকারের ব্রোঞ্জ মূর্তি নিয়ে গেছেন। সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে রাশিয়া জানিয়েছে, এই অঞ্চলের নোভা কাখোভকা শহরের বাঁধে বোমা হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে ইউক্রেন। এতে করে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাবে পুরো অঞ্চল।

মস্কোর ‘ফাঁদ’

তবে মস্কোর এই বক্তব্য উড়িয়ে দিয়েছে কিয়েভ। বৃহস্পতিবার ইতালির একটি সংবাদমাধ্যমকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘খেরসনের বাসিন্দা, রুশ সেনা আর মূর্তিগুলো সরিয়ে নেওয়া ক্রেমলিনের একটি সুপরিকল্পিত ফাঁদ ছাড়া আর কিছু নয়। এর মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তারা ভয় পেয়েছে। আসলে রাশিয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনারা নিজেদের জায়গাতেই আছেন। কেউ চলে যাননি। আমরা এটা ধরে ফেলেছি। রাশিয়াকে বিশ্বাস করি না।’

আল–জাজিরার সঙ্গে আলাপচারিতায় একই ধরনের কথা বলেছেন ইউক্রেনের একজন সেনা সদস্য। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে যুদ্ধক্ষেত্রে কয়েক মাস কাটিয়েছেন তিনি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, খেরসন থেকে বাসিন্দা ও সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার যেসব খবর রাশিয়ার গণমাধ্যমে আসছে, তা পূর্বপরিকল্পিত। ইউক্রেন এই ফাঁদে পা দেবে না।

ইউক্রেনের খেরসন, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক ও জাপোরিঝঝিয়ায় অঞ্চলকে সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়

ইউক্রেনের এই সেনার ভাষ্যমতে, খেরসনের মতো কৌশলগতভাবে এতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল থেকে রাশিয়া নিজেদের সেনা সদস্যদের সরিয়ে নেবে—এমনটা আশা করা যায় না। আর খেরসনে যেসব ইউক্রেনীয় সেনা সম্মুখযুদ্ধ করছেন, তাঁদের জীবনমান উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া উচিত কিয়েভের কর্মকর্তাদের। কারণ, সেখানে রাশিয়ার গোলা হামলার মধ্যে টিকে থাকার মতো কোনো আশ্রয় তাঁদের নেই।
এদিকে গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা গেছে, খেরসন ও নোভা

কাখোভকা শহরে দুর্গ নির্মাণসহ প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। শহর দুটির অবস্থান নোভা কাখোভকা বাঁধের কাছেই।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সাবেক উপপ্রধান ইহর রোমানেঙ্কো বলেন, নিপার নদীর পশ্চিম তীর থেকে পূর্বে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নেওয়াটা আগে থেকে পরিকল্পনা করা। এ নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সত্যটা হলো, লোকজন জড়ো করে রুশ বাহিনী সেখানে শক্তি বাড়াচ্ছে। ইউক্রেনীয়দের ওপর পাল্টা হামলা চালাতে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে।

‘শত্রুদের দুর্বলতা বের করতে হবে’


ইউক্রেনে অভিযান শুরুর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই জেলেনস্কি সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল রাশিয়া। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের আশাভঙ্গ হয়। এর জেরে কিয়েভের আশপাশ এবং উত্তর ইউক্রেন থেকে রুশ সেনাদের সরিয়ে নেওয়া হয়।

এরপর মস্কো চেয়েছিল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনবাস এলাকা পুরোটা দখলে নিতে। একই সঙ্গে তাদের আশা ছিল দক্ষিণ ইউক্রেনে কৃষ্ণসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো দখলে নেওয়া। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের প্রতিবেশী মলদোভার ট্রান্সনিস্ত্রিয়া অঞ্চলের সঙ্গে স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হবে মস্কোর। ট্রান্সনিস্ত্রিয়া রাশিয়ার দখলে রয়েছে। অনেক বছর ধরেই সেখানে ঘাঁটি গেড়েছেন রুশ সেনারা।

তবে রাশিয়ার সেই স্বপ্নও চূর্ণ হয়েছে। ইউক্রনের সেনারা উত্তরপূর্বাঞ্চলে খারকিভের বেশির ভাগ এলাকা দখলে নিয়েছেন। দনবাসের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলে রুশ সেনারা ইউক্রনীয়দের হামলায় চাপের মুখে রয়েছেন। খেরসনেও অনেক এলাকা রাশিয়ার হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছে।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সাবেক উপপ্রধান ইহর রোমানেঙ্কো বলেন, সম্প্রতি খেরসনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর হামলার গতি কমে এসেছে। এর একটি কারণ হতে পারে এ অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত ও কর্দমাক্ত রাস্তা। এরপরও বিভিন্ন কমান্ড সেন্টার, ডিপো ও রসদ পরিবহনের পথে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের শত্রুদের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে, সামরিক রসদ বাড়াতে হবে এবং সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এরপরই আমরা হামলা জোরদারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’