যুক্তরাজ্যে একাধিক রেকর্ড গড়ে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় শতকোটিপতি ঋষি সুনাক। এককালের উপনিবেশ থেকে উঠে অভিবাসী বংশোদ্ভূত হিসেবেও তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন। একই সঙ্গে তিনি হবেন কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পর ৪২ বছর বয়সী ঋষিই শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি–সেভেনে দ্বিতীয় অশ্বেতাঙ্গ সরকারপ্রধান হচ্ছেন। সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে পরাস্ত হয়ে অক্টোবরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়া বিশ্বজুড়ে বহু মানুষকে যে চমকিত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে তিনি তাঁর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য হয়তো কিছুটা অহংকারও করতে পারেন।
শতকোটিরও বেশি মানুষের দেশ ভারতে অনেকেই ঋষির নির্বাচনকে দেওয়ালির পুরস্কার গণ্য করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। তাঁর ধর্মীয় পরিচয় ও স্ত্রীর ভারতীয় নাগরিকত্ব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে। বছর দুয়েক আগে দেওয়ালিতে তিনি তাঁর সরকারি বাসভবন ডাউনিং স্ট্রিটের ১১ নম্বর বাড়িতে প্রদীপ প্রজ্বালন করে আলোচিত হয়েছিলেন।
সেপ্টেম্বরে ঋষি এমপিদের ভোটে এগিয়ে থেকেও পরাজিত হন পার্টির সদস্যদের ভোটে, অক্টোবরে তাঁর আর তৃণমূল সদস্যদের ভোটের কোনো প্রয়োজন হয়নি। দলীয় এমপিদের অর্ধেকের বেশি প্রকাশ্যে তাঁর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। আর তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, যিনি, সেই পেনি মরড্যান্ট মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট আগে হাল ছেড়ে দেওয়ায় ঋষি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচত হন। আর তার ১৭ ঘণ্টা আগে নাটকীয়ভাবে নেতৃত্বের দৌড় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
ঋষির নির্বাচিত হওয়া আরও যে কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তা হলো যুক্তরাজ্যে কোনো সরকারের পতন ঘটানোর জন্য কাউকে প্রধান অনুঘটক ভাবা হলে তাঁর সেই দলে নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড নেই। বরিস জনসনের বিদায়ের ক্ষেত্রেও দলটির তৃণমূলে বদ্ধমূল ধারণা যে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে ঋষির পদত্যাগই তখন সরকারের পতনের সূচনা করেছিল। তৃণমূলে সে ধারণায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটার কোনো আলামত মেলে না।
দলের তৃণমূল এবং বরিস জনসনের ভক্তদের সমর্থন আদায় ও দলকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্নটি ঋষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বরিসের প্রতি আনুগত্যের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী নাদিন ডরিস নির্বাচন থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এক টুইটে নতুন নির্বাচন ছাড়া যুক্তরাজ্যের চলমান সংকট থেকে উদ্ধারের যোগ্য নেতৃত্ব মিলবে না বলে মন্তব্য করেন।
কনজারভেটিভ পার্টিতে যাঁরা কর কমানো, ছোট আকারের সরকার এবং সামাজিক সহায়তার পরিমাণ কমানোর পক্ষে তাঁদের তুষ্ট করাও ঋষির জন্য দুরূহ হবে। কোভিড মহামারির সময়ে সবার জন্য উদারভাবে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দেওয়ার যেসব কর্মসূচি তিনি নিয়েছিলেন, দলটির অতি ডানপন্থী অংশটি তাকেই দেশটির মুদ্রাস্ফীতির কারণ হিসেবে দায়ী করে থাকে।
ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখীনতার কারণে জীবনযাপনে যাঁরা অসহায়ত্ব বোধ করছেন, তাঁদের জন্য কোনো বিশেষ সহায়তা দিতে গেলে তিনি দলের মধ্যেই বাধার মুখে পড়বেন। বিপরীতে, তাঁর ব্যক্তিগত ধনসম্পদ, যার পরিমাণ অন্তত ৭৩ কোটি পাউন্ড (ডলারে শতকোটির কাছাকাছি) হওয়ায় তিনি যে সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন, বিরোধী দলগুলোর এই অভিযোগ তাঁর জন্য বাড়তি মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে যুক্তরাজ্যে উচ্চহারের কর এড়াতে তাঁর স্ত্রীর বিদেশে সম্পদ রাখার বিষয়টি নিয়ে এর আগে বিরাট রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে।
মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ে তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হতে ঋষি সুনাককে একটি বাক্যও খরচ করতে হয়নি। এবার তিনি দলীয় এমপিদের নিয়ে কোনো নির্বাচনী সভা করেননি, কোনো সংবাদ সম্মলন করেননি, টেলিভিশন–রেডিওতে কোনো সাক্ষাৎকার দেননি, কিংবা কোনো নতুন মেনিফেস্টোও প্রকাশ করেননি। সেপ্টেম্বরের নেতৃত্বের লড়াইয়ের সময়ে তিনি এখনই কর কমানো সম্ভব নয় এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বোঝা কমাতে ও মন্দা এড়াতে কিছু রাষ্ট্রীয় সহায়তার কথা বলেছিলেন।
বিপরীতে লিজ ট্রাসের কর কমানো ও কথিত প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনাকে কল্পনার অর্থনীতি বলে অভিহিত করেছিলেন। লিজ ট্রাসের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যে সংকট ডেকে এনেছে, পাউন্ডের মূল্য কমে যাওয়া এবং সরকারি–বেসরকারি ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ার পটভূমিতে তাঁর প্রত্যাবর্তন তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঋষি নির্বাচিত হওয়ায় বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা হয়তো তাঁকে কিছুটা অহংকারীও করতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার লিজ ট্রাস পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর হঠাৎ করেই ক্ষমতায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে মাঠে নামেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ধারাবাহিক কয়েকটি কেলেঙ্কারির কারণে দলীয় এমপিদের অনাস্থার মুখে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া বরিসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা দলটির প্রবীণ নেতাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে এবং অর্থবাজার ও গণমাধ্যমে ভবিষ্যৎ অস্থিরতার আশঙ্কায় ক্ষোভমিশ্রিত হতাশার প্রকাশ ঘটে।
পার্লামেন্টকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্ত করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে এমপিদের একটি কমিটির তদন্ত শুরু করার কথা থাকায় বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব লাভ করে। তিনি মনোনয়নের জন্য নির্ধারিত ১০০ এমপির সমর্থন পেয়েছেন দাবি করলেও ঋষির প্রতিনিধিরা তাদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানান। এ রকম পটভূমিতে তাঁর সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে।
গত চার মাসে যুক্তরাজ্যে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে, তা এতটাই অস্বাভাবিক যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইউরোপীয় নেতারা প্রকাশ্যেই তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) লিজ ট্রাসের করনীতির সমালোচনা করেছিল, যা জি–সেভেনভুক্ত দেশগুলোর জন্য বিরল ও বিব্রতকর।
যুক্তরাজ্যের বিরোধী দলগুলো এ ধরনের অস্থিরতার পেছনে কনজারভেটিভ পার্টির অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত লড়াই অভিহিত করে দাবি করেছে যে দেশটির সংকট কাটানোর জন্য শুধু নেতা পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, দরকার নতুন রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক কর্মসূচির প্রতি ম্যান্ডেট।
গত ১২ বছরের ভ্রান্ত নীতির কারণেই অর্থনীতির এ দুর্দশা বলে দাবি করে তারা অবিলম্বে নতুন নির্বাচন দাবি করেছে। অনেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদের চুক্তি ব্রেক্সিটকেও এ অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য দায়ী করেছেন এবং ব্রেক্সিটের বিষয়ে নতুন করে আলোচনার দাবি তুলেছেন।
নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঋষি সুনাক যদি নিজ দলের মধ্যে দ্রুত ঐক্য ফিরিয়ে না আনতে পারেন এবং আইন প্রণয়নে বাধার সম্মুখীন হন, তাহলে নির্বাচনের দাবি যে আরও জোরালো হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নেতা নির্বাচনের এই দলীয় প্রতিযোগিতার মধ্যে পরিচালিত বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা গেছে বেশির ভাগ ভোটার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। সুতরাং, রাজনৈতিক টানাপোড়েনের যে এখনই ইতি ঘটছে, তা বলা যাচ্ছে না। আগাম নির্বাচনের পথে একমাত্র বাধা এখন কনজারভেটিভ পার্টির বড় ধরনের পরাজয়ের আশঙ্কা। কেননা, সব জনমত জরিপেই এখন লেবার পার্টি এগিয়ে আছে।