দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইউক্রেনের ওপরে থাকা বিধিনিষেধ দিন কয়েকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তুলে নিতে পারে বলে জোরালো ইঙ্গিত রয়েছে।
ইউক্রেনকে ইতিমধ্যে এই ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। তবে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি ‘বিধিনিষেধ’ আছে। ইউক্রেন এখন তার নিজস্ব সীমানার মধ্যে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে হামলার ক্ষেত্রেই শুধু এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারছে।
কিয়েভ কয়েক সপ্তাহ ধরে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে আসছে। তারা এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে চায়।
তাহলে এত দিন এ ব্যাপারে পশ্চিমাদের অনাগ্রহের কারণ কী? আর এই ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধে কী ধরনের পার্থক্য গড়ে দিতে পারে?
স্টর্ম শ্যাডো হলো একটি অ্যাংলো-ফরাসি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যার সর্বোচ্চ পরিসীমা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। ফরাসিরা এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘স্ক্যাল্প’ বলে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ইতিমধ্যে এই ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। তবে তারা কিয়েভকে শর্ত দিয়েছে, তারা কেবল নিজেদের সীমানার ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।
এই ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া হয়। এরপর তা শব্দের গতির কাছাকাছি দ্রুততায় লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছুটে যায়। ভূমির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এই ক্ষেপণাস্ত্রে উচ্চ বিস্ফোরকযুক্ত ওয়ারহেড আছে।
সুকঠিন বাংকারসহ গোলাবারুদের নিরাপদ ভান্ডার ধ্বংস করার আদর্শ অস্ত্র হিসেবে স্টর্ম শ্যাডোকে বিবেচনা করা হয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে রাশিয়া।
তবে এই ক্ষেপণাস্ত্র বেশ ব্যয়বহুল। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে প্রায় এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের অর্থ ব্যয় হয়। তাই শত্রুর বিরুদ্ধে হামলায় এই অস্ত্র হিসাব করে ব্যবহার করা হয়। যেমনটা ইউক্রেনে হামলার ক্ষেত্রে রাশিয়া করে।
এই অস্ত্র শত্রুপক্ষের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত-বিপর্যস্ত করে দিতে সক্ষম। এই অস্ত্রের প্রভাব ব্যাপক। যেমন দখলকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সেভাস্তোপোলে রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর নৌবহরের সদর দপ্তরে হামলায় এ অস্ত্র ব্যবহার করেছিল ইউক্রেন। তারা পুরো ক্রিমিয়াকে রুশ নৌবাহিনীর জন্য অনিরাপদ করে তোলে এই অস্ত্রের সাহায্যে।
সামরিক বিশ্লেষক ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা জাস্টিন ক্রাম্প বলেন, স্টর্ম শ্যাডো ইউক্রেনের জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর অস্ত্র। এই অস্ত্র রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলের সুরক্ষিত লক্ষ্যবস্তুতে যথাযথভাবে আঘাত হানছে।
জাস্টিন ক্রাম্প বলেন, এটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে কিয়েভ রাশিয়ার অভ্যন্তরে এই অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য পশ্চিমাদের কাছে তদবির করে আসছে। বিশেষ করে তারা গ্লাইড বোমা হামলা চালানোর জন্য রাশিয়ার ব্যবহৃত বিমানঘাঁটিগুলোকে নিশানা করতে চায়।
ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরসহ যেসব জায়গায় লড়াই চলছে, সেখানে প্রতিদিন আকাশপথে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া।
রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও গ্লাইড বোমা ইউক্রেনের সামরিক অবস্থানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। ইউক্রেনের সামরিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
কিয়েভের অভিযোগ, পশ্চিমাদের অনুমতি না থাকায় তারা স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার ভেতরে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে পারছে না। এর ফলে রাশিয়া এসব ঘাঁটি ব্যবহার করে ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে লড়াইয়ে ইউক্রেন পিছিয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি প্রাগে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তাবিষয়ক এক সম্মেলনে এমন মত উঠে আসে যে স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের ওপর বিধিনিষেধ থাকার সুবিধা পাচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়ার সামরিক বিমানঘাঁটিগুলো সুরক্ষিত থাকায় তারা ইউক্রেনে নির্বিঘ্নে হামলা চালিয়ে যেতে পারছে। পক্ষান্তরে বেসামরিক নাগরিকসহ ইউক্রেনীয় পক্ষ ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
ইউক্রেনের নিজস্ব, উদ্ভাবনী ও কার্যকর দূরপাল্লার ড্রোন কার্যক্রম রয়েছে। কখনো কখনো এই ড্রোন রাশিয়ার অভ্যন্তরে কয়েক শ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হলো এই ড্রোন একটি ছোট অস্ত্র বহন করতে পারে। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এই ড্রোন রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় ধরা পড়ে যায়, ভূপাতিত হয়।
কিয়েভের যুক্তি, আকাশপথে রাশিয়ার হামলা রুখে দিতে এবং যুদ্ধে রাশিয়াকে পেছনে ফেলতে দেশটির ভেতরে আঘাত হানার জন্য ইউক্রেনের স্টর্ম শ্যাডোসহ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা দরকার।
এই প্রশ্নের এককথায় উত্তর হলো, এতে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।
ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন যে ইউক্রেনকে যদি পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আরও খেপিয়ে দিতে পারে। তখন তিনি প্রতিশোধের পথ বেছে নিতে পারেন। তখন যুদ্ধ ইউক্রেনের বাইরে চলে যেতে পারে। যেমন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য পোল্যান্ড রুশ হামলার শিকার হতে পারে।
ন্যাটোর নিয়ম হলো, সদস্যভুক্ত কোনো দেশ আক্রমণের শিকার হলে সদস্যদেশগুলো একযোগে আক্রান্ত দেশটিকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে। অর্থাৎ, সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো জোটের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। এই যুদ্ধের পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর।
ইউক্রেনকে যদি রাশিয়ার ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তা কিয়েভকে কিছুটা সুবিধা দিতে পারে বলে মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞেরা।
তবে এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাশিয়া ইতিমধ্যে সতর্কতামূলক নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তারা বোমারু বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও কিছু সামরিক অবকাঠামো ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে দূরে, এমনকি স্টর্ম শ্যাডোর সীমার বাইরে নিয়ে গেছে।
সামরিক বিশ্লেষক জাস্টিন ক্রাম্প মনে করেন, রাশিয়ার সতর্কব্যবস্থা সত্ত্বেও দেশটির ভেতরে হামলা চালাতে স্টর্ম শ্যাডো ব্যবহারের অনুমতি এখনো যদি ইউক্রেনকে দেওয়া হয়, তাহলেও মস্কোকে নানা ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
তবে স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র এই যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিতে পারে, এমন সম্ভাবনা কম বলেই মনে করেন সামরিক বিজ্ঞানবিষয়ক চিন্তন প্রতিষ্ঠান রুসির পরিচালক ম্যাথিউ স্যাভিল।