৩৪ বছর ধরে একটা খুনের রহস্যের কিছুতেই কিনারা করা যাচ্ছিল না। খুনি চোখের সামনে দিয়ে বারবার গেছেন, কিন্তু কখনোই তাঁকে নিয়ে সন্দেহ জাগেনি। তদন্তের পর তদন্ত হয়েছে। কমিশন বসেছে। কিন্তু প্রকৃত খুনির হদিস পাওয়া যায়নি। সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমের রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের কথাই বলা হচ্ছে, যিনি ১৯৮৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিনেমা দেখে স্ত্রীকে নিয়ে ফেরার পথে স্টকহোমের রাস্তায় আততায়ীর হাতে খুন হন। তাঁকে পেছন থেকে গুলি করে দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যান আততায়ী।
প্রধানমন্ত্রীকে খুনের এ ঘটনার ডজনখানেক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও গুলি করে পালিয়ে যাওয়া সেই আততায়ীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই। পুলিশ ও তদন্তকারীরা বারবার ব্যর্থ হলেও ব্যর্থ হননি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক থমাস পিটারসন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ ঘটনার অনুসন্ধান করেন। প্রথম সন্দেহভাজন হিসেবে স্টিগ ইংস্ট্রম নামের এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেন তিনি। ইংস্ট্রমের মৃত্যুর ১৮ বছর পর পুলিশ তাঁকে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।
গতকাল বুধবার সুইডেনের বিচার বিভাগ রহস্যময় ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য স্টিগ ইংস্ট্রমকে দোষী সাব্যস্ত করে দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে চলা রহস্যময় মামলার ইতি টেনেছে। স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে কৌঁসুলি ক্রিস্টার পিটারসন বলেছেন, স্টিগ ইংস্ট্রমকে দায়ী করার যুক্তিসংগত প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি বিমা সংস্থার গ্রাফিক ডিজাইনার ছিলেন। ২০০০ সালে ৬৬ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করেন। তিনি দোষী ছিলেন কি না, সে সম্পর্কে আদালত রায় দিতে পারেন, তবে সন্দেহভাজন যেহেতু মৃত, তাই আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হবে না। ইংস্ট্রম আরও বড় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কাজ করেছিলেন কি না, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারির এক শীতের রাতে স্ত্রী লিজাবেথকে নিয়ে স্টকহোমের থিয়েটার থেকে বেরোনোর সময় আততায়ী পেছন থেকে গুলি ছোড়েন। পুরো সুইডেনে এ ঘটনা ঝড় তুললেও আততায়ীকে বের করতে না পারায় দেশটির সবচেয়ে রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডে রূপ নেয় এটি। গোয়েন্দারাও এর কিনারা করতে পারছিলেন না। এ নিয়ে সুইডেনজুড়ে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জন্ম হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, মৃত্যুর আগে কয়েক দশক ধরে সুইডেনের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পালমে। টানা দুই মেয়াদ তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। স্ক্যান্ডেনেভিয়া অঞ্চলের ভালো অবস্থার পেছনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একজন উদার, সমাজতান্ত্রিক, আদর্শবাদী, যিনি বিশ্বজুড়ে চলা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষী সরকারের মধ্যে তাঁর শত্রু তৈরি হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি তৃতীয় পথ চেয়েছিলেন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।
এই মামলার কৌঁসুলি পিটারসন বলেছেন, কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা যায়, এমন এক বিশেষ তদন্তের পর তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
তবে তদন্তের ফলাফলে কোনো আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল না। এ রহস্যের কিনারা ২০১৮ সালে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক থমাস পিটারসন করে রেখেছিলেন। তাঁর অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসে বারবার চোখের সামনে থেকেও ধুলা দিয়ে যাওয়া খুনি ইংস্ট্রমের নাম।
সাংবাদিক পিটারসন অনুসন্ধানের সময় খুনির সঙ্গে একজন অস্ত্র সংগ্রাহক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারা সম্পর্ক খুঁজে পান, যিনি পালমে ও তাঁর সমাজবাদী আদর্শকে মোটেই দেখতে পারতেন না। কৌঁসুলি পিটারসন বলেন, ২০১৭ সালে পুলিশ একটি অস্ত্র খুঁজে পায়, যা সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, কৌঁসুলি পিটারসন তাঁদের তদন্তে সাংবাদিকের অনুসন্ধানের কোনো ভূমিকা নেই বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁরা তদন্তে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ওই সাংবাদিকের অনুসন্ধানেও তা-ই উঠে এসেছে।
গত কয়েক দশকে এ হত্যাকাণ্ডের কিনারা করতে না পারায় সুইডেনের বিচার বিভাগ ও পুলিশকে নানা সমালোচনা সইতে হয়েছে। ছয়বার তদন্ত ও তিনবার কমিশন বসেছে। খুনের সন্দেহভাজন হিসেবে ইংস্ট্রমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও নিজেকে এই মামলার সাক্ষী হিসেবে প্রমাণ করে কৌশলে ধোঁকা দিতে পেরেছিলেন।
গোথেনবার্গের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক পিটারসন অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারলেন, যে থিয়েটারের কাছে প্রধানমন্ত্রী পালমে খুন হন, ঠিক তার কাছেই একটি ভবনে কাজ করতেন ইংস্ট্রম। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছিলেন, ঘটনাস্থলে তিনি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নিজে শুটিং ক্লাবে সক্রিয় ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাঁর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যও ছিল। সম্ভাব্য আততায়ী হওয়ার জন্য তাঁর প্রোফাইলও মিলে যায়। খুনের ওই ঘটনার সময় ইংস্ট্রমের বয়স ছিল ৫২। জীবনে অনেক কিছু নিয়েই তিনি নাখোশ ছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক পিটারসন বলেছিলেন, চাকরিতে ইংস্ট্রমের উন্নতি হয়নি। প্রত্যাশিত পদোন্নতি পাননি। পরিবার ছিল না। জীবনে কোনো আশা ছিল না। জীবনের ওই সময়টাতে হতাশ ছিলেন তিনি। তবে নিজেকে চেনানোর চেষ্টা করছিলেন। নিজের জন্য বড় কিছু করার কথা ভাবছিলেন। এ জন্য (এই খুনের ঘটনার পর) দীর্ঘদিন বিষয়টা সংবাদমাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে ছিল, এটা তাঁর ভালোই লাগত। হত্যাকাণ্ডের সময়টাতে তদন্তকারীরা কুর্দি জঙ্গিদের সন্দেহ করায় তাঁকে অতটা গুরুত্ব দেননি।
এ মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে ১৩ বছর ধরে অনুসন্ধান চালানোর পর ইংস্ট্রমকে খুনি বলে ঠিক করতে পেরেছিলেন বলে জানান সাংবাদিক পিটারসন। সঠিক সময়, সঠিক পোশাক আর অন্যান্য তথ্য নিয়েই তিনি গুলি চালান। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মিথ্যা বলেছেন। পালমেকে দেখতে পারতেন না তিনি।
অনুসন্ধানের বিস্তারিত ২০১৭ সালে পুলিশের হাতে তুলে দেন সাংবাদিক পিটারসন। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ আবার ইংস্ট্রমকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধান শুরু করে। কয়েকজন গোয়েন্দাসহ কৌঁসুলি পিটারসন এরপর তদন্ত শুরু করেন। ইংস্ট্রমের আত্মীয়দের ডিএনএ সংগ্রহ করেন, তাঁর পুরোনো বাড়িতে অনুসন্ধান চালানো হয় এবং আগে যাঁদের নামও জানা যায়নি, তাঁদেরও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।
এদিকে ইংস্ট্রমের পরিবার তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাঁর সাবেক স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১৮ সালে এক্সপ্রেসেন সংবাদপত্রকে তিনি বলেন, এটা প্রশ্নাতীত। তিনি এ ধরনের মানুষ ছিলেন না। তিনি এতটা সাহসী ছিলেন না। মাছি মারাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী পালমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্রিস্টার পিটারসন নামের এক সাধারণ অপরাধীকে ১৯৮৯ সালে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ওই বছরই আপিল করে তিনি জিতে যান। ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ক্রিস্টার পিটারসনকে রক্ষার পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ইংস্ট্রম।
সাংবাদিক পিটারসন বলেন, ইংস্ট্রম ভয়াবহ বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি নিজেকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। প্রতিবার নিজের গল্প বলতেন। তদন্তকারী ও অন্য সাক্ষীদের জন্য আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছিলেন তিনি।
পালমেকে হত্যার পেছনে যেসব ষড়যন্ত্রতত্ত্ব চাউর হয়েছিল, তার মধ্যে বেশির ভাগই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে ঘিরে গড়ে ওঠা শত্রুতাকেন্দ্রিক। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে শত্রুতা, ভারতের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি নিয়ে ইতালি বা চিলির শত্রুদের প্রতিশোধ, এমন নানা কথা শোনা যায়। তবে এতকাল পর এসে সুইডেনের বিচার বিভাগ জানাল, এটা এক লোকের ঘটানো ঘটনা। কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না, এমন একজন মৃত ব্যক্তিকে পালমের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
খুনির উদ্দেশ্য কী ছিল, তা দীর্ঘ অনুসন্ধানে বের করা সাংবাদিক পিটারসনের মতে, খুনি নজর কাড়তে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন এবং দীর্ঘকাল পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে বেড়িয়েছেন। ২০০০ সালে আত্মহত্যা করেন ইংস্ট্রম।