বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। কে কার চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তৈরি করতে পারছে, সেটা হয়ে গেছে গৌরবের ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রতিযোগিতার কোনো শেষ নেই। মূলত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিভিন্ন দেশ নতুন নতুন ধরনের অস্ত্র তৈরি করছে। এমন একটি প্রাণঘাতী অস্ত্র হলো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। এ ক্ষেপণাস্ত্র এতই শক্তিশালী যে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার উপযোগী নতুন এসব অস্ত্রকে ‘অপ্রতিরোধ্য’ বলে বর্ণনা করেছেন বিশ্লেষকেরা।
রাশিয়া ইউক্রেনে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করার পরপরই ‘অপ্রতিরোধ্য’ এ ক্ষেপণাস্ত্র নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ২০ মার্চ রাশিয়া জানায়, ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে দেশটির সামরিক বাহিনীর জ্বালানি মজুতের একটি স্থাপনাসহ একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে কিনঝাল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই রাশিয়া প্রথমবার যুদ্ধে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। নতুন এ ক্ষেপণাস্ত্র কী ও কেন এসব ক্ষেপণাস্ত্র উল্লেখ্যযোগ্য, সংক্ষেপে তারই বিবরণ তুলে ধরা হলো—
হাইপারসনিক শব্দের অর্থ হচ্ছে এমন কিছু, যা শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ গতিতে ছুটতে পারে। ঘণ্টায় এর গতি ৬ হাজার ১৭৪ কিলোমিটার বা ৩ হাজার ৮৩৬ মাইল। এককথায় এর গতি চূড়ান্ত পর্যায়ের। এর গতিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়। কারণ, এত দ্রুত ছোটে যে বিরোধীপক্ষ সতর্ক বা একে ঠেকানোর মতো সময় পায় না।
বেশির ভাগ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের গতি অবশ্য এ রকম তারপরও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র আলাদা কেন? এর অন্যতম কারণ বায়ুমণ্ডলের উঁচু স্তরে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রায় নিঃশব্দে ও অবিরত ছুটতে থাকে এবং এটা অত্যন্ত কৌশলী। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হলো বল ছুড়ে মারার মতো। কারণ, এটি একবার ছোড়ার পর এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এগিয়ে। ছোড়ার পরও এটির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্র দুই ধরনের। প্রথমটি হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলস (এইচজিভিএস)। এটি পৃথিবীপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডল ছেড়ে চলে যায় এবং তারপর আবার পৃথিবীপৃষ্ঠে ফিরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। মাঝখানের সময় এটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। যাওয়ার সময় এটি একটি অগভীর স্থানে উঁচু স্তর ও এলোমেলো বক্ররেখায় ছুটে। কারণ, শত্রুপক্ষ যেন এর অবস্থান শনাক্ত করতে না পারে। মূলত শত্রুপক্ষের রাডারকে ফাঁকি দিয়ে তাদের বোকা বানিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করাই এটির উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়টি হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল (এইচসিএম)। আগেরটির মতো এর গতি অত বেশি নয়। এরপরও এটি অনেক উচ্চগতিতে ছুটতে পারে। মূলত এটির নকশা করা হয়েছে কিছুটা নিচু স্তর দিয়ে ছোটার জন্য। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র শত্রুপক্ষকে অবাক করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে এবং প্রতিহত করার তেমন সময়ও দেয় না।
দুই ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ অপরিসীম। বাতাসে চরম গতি নিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ঘর্ষণ একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া তাপমাত্রা ২ হাজার ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩ হাজার ৯৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, টাইটানিয়ামের মতো ধাতব পদার্থও ১ হাজার ৬৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গেলে গলে যায়। ফলে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের আকারের সঙ্গে এগুলো তৈরির সময় এ ধরনের পরিস্থিতির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়।
এসব ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা একটি বড় সমস্যা। কারণ, মেঘের অন্তরালে সেখানে অতিমাত্রায় উত্তপ্ত কিছু বস্তুকণা থাকে। এসব বস্তুকণাকে বলা হয় প্লাজমা। এগুলোর কারণে সেখানে বেতার যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করা খুব কঠিন। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সফলভাবে কিনঝাল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারের মানে হলো বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়া যুদ্ধে এ ধরনে অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এরপরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। যেমন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার কম ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কেন এসব ব্যয়বহুল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে?
যেকোনো ধরনের সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধে নতুন নতুন অস্ত্র পরীক্ষার একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এতে বাস্তবে এসব অস্ত্র কতটা কার্যকর, সেটাই পরীক্ষা করে দেখা যায়। সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে হয়তো কিছুটা উপসংহারে পৌঁছানো যায়, কিন্তু যুদ্ধে এসব অস্ত্রের ব্যবহারের রয়েছে দুটি দিক। সেটা হলো ব্যর্থ, নয়তো সফল। যুদ্ধে এসব অস্ত্রের ব্যবহারের মূলে সফল হলে হলো, না হলে এর ত্রুটি ঠিক করা। রাশিয়া মূলত যুদ্ধে ব্যবহার করে এর সাফল্য-ব্যর্থতাই যাচাই করছে।