সুইস ব্যাংকে তথ্য গোপন রাখার দিন শেষ

সুইস ব্যাংকের হিসাবধারীদের গোপনীয়তার যুগ শেষ। ছবি: রয়টার্স
সুইস ব্যাংকের হিসাবধারীদের গোপনীয়তার যুগ শেষ। ছবি: রয়টার্স

শেষ হলো সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তার যুগ। অর্থ গোপনে গচ্ছিত রাখার জন্য অনেক ধনীরই পছন্দ সুইজারল্যান্ড। গ্রাহকের নাম-পরিচয় গোপন রাখতে কঠোর দেশটির ব্যাংকিং খাত। যে কারণে অবৈধ আয় ও কর ফাঁকি দিয়ে জমানো টাকা রাখা হয় সুইস ব্যাংকে। এর সমাপ্তি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

এখন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিভিন্ন দেশের কয়েক ডজন কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গ্রাহকের তথ্য ভাগ করে নেবে সুইস ব্যাংক। কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য উচ্চ আয়ের যেসব ইউরোপীয় নাগরিক অফশোর ব্যাংকিংয়ের সহায়তা নিত, তাদের তথ্য আর সে দেশের সরকারের কাছে গোপন রাখবে না সুইজারল্যান্ড।

গত শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফটিএ) জানায়, কর ফাঁকি রোধে আন্তর্জাতিকভাবে নেওয়া উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে তারা হিসাবধারীর ব্যক্তিদের তথ্য চেয়ে করা আবেদনে সাড়া দিয়েছে। কর প্রতারণা কমাতে গত সেপ্টেম্বরে প্রথম বিশ্বব্যাপী মানদণ্ডের অধীনে গ্রাহকের আর্থিক তথ্য বিনিময় করে তারা। এর আগে কখনোই এফটিএ এ ধরনের আবেদনে সাড়া দেয়নি।

ব্যাংকের গোপনীয়তা এখনো কিছু এলাকায় বিদ্যমান থাকবে। গ্রাহকের দেশীয় হিসাবে কী পরিমাণ অর্থ আছে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখতে পারবে না সুইস কর্তৃপক্ষ। তবে ইউরোপীয় ধনীদের কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিদেশের ব্যাংকে সম্পদ গচ্ছিত রাখার দিন শেষ।

প্রাথমিকভাবে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আইসল্যান্ড, ইজেল অব ম্যান, জাপান, নরওয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়া ও ইইউভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের তথ্য সরবরাহ করেছে সুইজারল্যান্ড। আগুয়ান বছরগুলোয় বিশ্বের ৮০টি দেশ এই তালিকায় যুক্ত হবে। এফটিএ জানিয়েছে, সাইপ্রাস ও রোমানিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কারণ তারা তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা ও তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতের শর্ত পূরণ করতে পারেনি।

এখন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিভিন্ন দেশের কয়েক ডজন কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গ্রাহকের তথ্য ভাগ করে নেবে সুইস ব্যাংক। ছবি: রয়টার্স

প্রায় সাত হাজার ব্যাংক, ট্রাস্ট, বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাঁদের লাখো গ্রাহকের হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করতে এফটিএতে নিবন্ধন করেছে। তারা তাদের তথ্য সুইস কর সংস্থায় পাঠিয়ে দেয়। তাদের চাওয়া তথ্যের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২০ লাখ হিসাবধারীর তথ্য সরবরাহ করেছে সুইজারল্যান্ড। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে হিসাবধারীর নাম, ঠিকানা, দেশ, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর, হিসাবে থাকা অর্থের পরিমাণসহ বিভিন্ন বিষয়। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে ওই দেশগুলোর কর বিভাগ বুঝতে পারবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সুইস ব্যাংকে অর্থ রেখে কর ফাঁকি দিচ্ছেন কি না।

যেসব দেশ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চায়, তাদের তথ্যের গোপনীয়তা ও তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে হবে। দেশগুলো এসব শর্ত পূরণ করতে পারছে কি না, তা তদারকি করবে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) ‘ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন ফর ট্যাক্স পারপাসেস’ ফোরাম।

সুইস নাগরিকদের ক্ষেত্রে অবশ্য গোপনীয়তার সুবিধা থাকছে। সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাইলেই দেখতে পারেন না।

২০১৭ সাল পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।

কর ফাঁকি দিতে অনেক দেশের ধনী নাগরিকদের জন্য স্বর্গ হয়ে উঠেছিল সুইস ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক বছরে কঠোর হতে শুরু করে সুইজারল্যান্ড সরকার। সুনির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য না দিলেও কয়েক বছর ধরে দেশভিত্তিক আমানতের পরিমাণ প্রকাশ করে আসছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি)। এই কঠোর অবস্থানের কারণে ২০১৭ সালে এসে আমানতও কমেছে তাঁদের। অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখার বিষয়ে গোপনীয়তা কমতে থাকায় অনেক ধনী এখন অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য ঝুঁকছেন লুক্সেমবার্গ, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, পানামা, বারমুডা, এমনকি ঘরের কাছের সিঙ্গাপুরের মতো দেশের দিকে।