সন্ত্রাসের সঙ্গে করোনাভাইরাসের মিল-অমিল

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার সারা পৃথিবীকে স্থবির করে দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনকে এলোমেলো করে দেওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে এই কোভিড-১৯। ঠিক অনেকটা সন্ত্রাসবাদের মতো। বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, নতুন করোনাভাইরাসের আছে নিজস্ব ঘরানার সন্ত্রাস। আর এরই মধ্যে তার অনুভব ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইউরোপে এরই মধ্যে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ সৃষ্টি হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অন্যান্য অঞ্চলেও একই অবস্থা। মানুষ প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে এই প্রথমবারের মতো মানুষ সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কোনো কারণে কুঁকরে গেছে। চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসকে মানুষ ঠিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আর এর ফলে সবার মধ্যে একটি আশঙ্কা ঢুকে গেছে যে ‘এরপর আমিও আক্রান্ত হতে পারি’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত সন্ত্রাস সাধারণত কোনো আদর্শিক অবস্থান থেকে শুরু হয়। তাকে ঠেকানোর জন্য কিছু পদক্ষেপও নেওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা যায়। বড় বড় সভা-সমাবেশ করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো যায়। কিন্তু করোনাভাইরাস এমন এক সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে, যার বিরুদ্ধে এর সবই অচল। এখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে মাস্ক ও গ্লাভস। কোনো আড়িপাতা যন্ত্র এখন আর মানুষকে নিরাপদ করতে পারছে না। কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একে ঠেকানো যাচ্ছে না।

ট্রটস্কি একসময় বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য মানুষকে ভয় পাওয়ানো, আতঙ্কগ্রস্ত করা।’ ঠিক সেই কাজটিই করে চলেছে নতুন করোনাভাইরাস। ভয় পাওয়াচ্ছে মানুষকে। কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে এটি সীমাবদ্ধ নেই; বরং গোটা বিশ্বে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের অদৃশ্য শত্রু হয়ে উঠেছে এটি।

লন্ডনের কিংস কলেজের সিকিউরিটি স্টাডিজের অধ্যাপক পিটার আর নিউমান বলছেন, সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে মানুষের শত্রু মানুষই হয়। আবার আদর্শিক শত্রুতাও থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাস এমন এক বিষয়, যার সম্পর্কে মানুষ এখনো বিশদভাবে জানে না। একে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তাই মানুষ ভয় পাচ্ছে।

ফাইল ছবি: এএফপি

আবার প্রচলিত সন্ত্রাস মানবসৃষ্ট। নতুন করোনাভাইরাস সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতি থেকে। অসলোর নরওয়েজিয়ান ডিফেন্স রিসার্চ এসটাবলিশমেন্টের সন্ত্রাসবাদবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক থমাস হেগহ্যামার বলছেন, মানবসৃষ্ট হুমকিতে সাধারণ মানুষ বেশি ভয় পায়, যদিও এই হুমকি ক্ষতি করে তুলনামূলক কম। অন্যদিকে প্রকৃতিসৃষ্ট বিপর্যয় ক্ষতি করে বেশি এবং এর বিস্তারও ব্যাপক। ঠিক তেমনি করোনাভাইরাস সমাজে সন্ত্রাসবাদের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে এবং ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ব্যাপকভাবে।

নতুন করোনাভাইরাস আরেকটি বিষয় ছড়াচ্ছে। তা হলো, অসহায়ত্ব। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে এর মিল আছে। এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষ জানতে পারছে না, কখন সে আক্রান্ত হবে। এই অনিশ্চয়তা মানুষকে ভঙ্গুর করে তোলে।

তাহলে মুক্তির পথ কী?

জর্জটাউনের আইনের অধ্যাপক জোশুয়া এ গেটজার বলছেন, সবাইকে এক হয়ে ভাবতে হবে, গড়ে তুলতে হবে সমন্বিতভাবে কাজ করার অভ্যাস। সবার মধ্যে সহমর্মিতার মনোভাব গড়ে তোলা প্রয়োজন। বুঝতে হবে যে ঘরে থাকাই এখন প্রতিরোধের অংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোও এখন চরম পরীক্ষা দিচ্ছে। শুধু অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধ করে যে নতুন করোনাভাইরাসের মতো হুমকি মোকাবিলা করা যাবে না, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করা আগে খুব সাধারণ ব্যাপার বলে বিবেচিত হতো। এখন সেই ধারণা পাল্টানোর সময় চলে এসেছে। কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়েছে যে একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে কতটা হুমকিতে ফেলতে পারে।

নতুন করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীতে প্রকট করে তুলতে পারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভেদ। তবে একই সঙ্গে তা এ-ও বুঝিয়ে দিয়েছে যে নাগরিক দায়িত্ববোধের চর্চাই মুক্ত সমাজব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।