সংসদীয় গণতন্ত্র যে কার্যকর, বরিসের পতন তার প্রমাণ

বিতর্কের মুখে দলীয় মন্ত্রী–এমপিদের সমর্থন হারিয়ে নেতৃত্ব ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন বরিস জনসন।

বরিস জনসন

‘পুরো ঘটনাটিই অবিশ্বাস্য। আমি যখন এ কথাগুলো লিখছি, তখনো__ডাউনিং স্ট্রিটে গেঁড়ে বসে আছেন। তিনি সিনাই মরুভূমির অবৈধ বসতি স্থাপনকারীর মতো কিংবা টিভির ধারাবাহিক নাটক দ্য অফিসের সেই বিব্রতকর পর্বটির ডেভিড ব্রেন্টের মতো মানতেই পারছেন না যে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’

১২ বছর আগে ২০১০ সালের ১০ মে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার শুরুটার অনুবাদটুকুতে শূন্যস্থানটি পূরণ করে নিতে যাঁর নাম আপনার মনে আসবে, লেখাটা তাঁরই। কথাগুলো লিখেছিলেন টেলিগ্রাফ–এর তখনকার কলামিস্ট বরিস জনসন, সে সময়ের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন সম্পর্কে। কথাগুলো যে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব অবসানে নিষ্ঠুর সত্য হয়ে উঠবে, সেটা তখন তিনি ভাবতে পারেননি।

বরিস জনসনকে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে সরাতে ৩৬ ঘণ্টায় অন্তত ৫২ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও পার্লামেন্টারি উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করে প্রকাশ্যে বলতে হয়েছে সততা, ভব্যতা ও নৈতিকতা বর্জন করে তাঁর নেতৃত্বে আর কাজ করা সম্ভব নয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে পদত্যাগ করা মন্ত্রীদের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য তাঁর দলের প্রায় সাড়ে তিন শ এমপির মধ্যেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না।

বরিস জনসন তাঁর ভাষায় ‘বিশ্বের সেরা চাকরিটি’ ধরে রাখতে যে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছেন, পাশ্চাত্যের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তা একমাত্র সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনীয়, যিনি নির্বাচনে পরাজয় নাকচ করতে সব ধরনের চেষ্টাই করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরিস জনসনকে যে ব্রিটিশ ট্রাম্প বলেছিলেন, সম্ভবত খুব একটা ভুল বলেননি।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বরিস যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন, তা ১৯৮৭ সালের পর আর কেউ পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের অনমনীয় অঙ্গীকারের কারণে দলটিতে তাঁর নেতৃত্ব এতটাই সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল, আপাতত ‘তাঁর কোনো বিকল্প নেই’ বলেই দলটির সমর্থকেরা বলে আসছিলেন। তাঁর জায়গায় কে আসবেন—সে কথা কেউই এখন বলতে পারছে না, যেমনটি বলা হতো টনি ব্লেয়ারের বিকল্প গর্ডন ব্রাউন কিংবা ডেভিড ক্যামেরনের বিকল্প থেরেসা মে অথবা বরিস জনসন। এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে উপর্যুপরি মিথ্যা বলা বা নিজের তৈরি আইন নিজে না মানার অভিযোগে মাস দুয়েক আগেও তাঁকে দলের এমপিরা পদচ্যুত করতে চাননি।

মার্কিন তরুণী জেনিফার আর্চারির সঙ্গে নিজের যৌনজীবন নিয়ে কেলেংকারির অভিযোগও বরিসের জনপ্রিয়তা ও কর্তৃত্বকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। অথচ দলীয় এমপি ক্রিস পিনচারের যৌন অপরাধের অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁকে ডেপুটি চিফ হুইপ পদে নিয়োগ করাই তাঁর জন্য কাল হলো। ক্রিস পিনচারের বিরুদ্ধে এর আগেও একই ধরনের অভিযোগ ছিল। বরিস তা জেনেও অপরাধীকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং কেলেংকারি ফাঁস হওয়ার পর সত্য আড়াল করেছেন, মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। ধারাবাহিকভাবে অসত্য বলার অভিযোগ মোকাবিলা করা তাঁর সহকর্মী মন্ত্রী ও দলীয় এমপিদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না।

মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বরিস জনসন বলেছিলেন যে মানসিকভাবে তাঁর রূপান্তর ঘটবে বলে যদি কেউ আশা করেন, তা কখনোই হবে না। নিজেকে না বদলানোর এমন জোরালো দাবির পর তাঁর এমন পরিণতি মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

বরিসের সময় যে শেষ হয়ে আসছিল, তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু তা যে দলীয় এমপিদের অনাস্থা ভোট উতরে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘটবে, সেটা কেউই ভাবেনি। করোনা মহামারির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে কড়া লকডাউনের মধ্যেই ডাউনিং স্ট্রিটে ডজনখানেক পার্টি করার কারণে যে রাজনৈতিক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, সেই পটভূমিতেই গত ৬ জুন তাঁর দলের এমপিদের মধ্যে আস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বরিস জনসনই হলেন একমাত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, যাঁকে পদে থাকা অবস্থায় আইন ভাঙার জন্য পুলিশ জরিমানা করে।

এ ছাড়া সরকারের প্রশাসনিক তদন্তেও তাঁর নেতৃত্বের সমালোচনা করে অনৈতিক আচরণের অভিযোগ করা হয়। বিরোধী দলগুলো তো বটেই, এমনকি টোরি পার্টির সমর্থক সংবাদপত্র টাইমসও তাঁকে ‘সিরিয়াল লায়ার’ আখ্যায়িত করে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিল।

বরিস জনসন ঘোষণা করেছেন, তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন। প্রচলিত রীতিও তাই। তিনি মন্ত্রিসভায় নতুন করে নিয়োগও দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু তাঁর সাবেক সহকর্মী মন্ত্রী এবং এমপিদের অনেকেই বলছেন, তাঁর প্রতি কারও আস্থা নেই এবং অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হোক। তাঁদের মতে, চলমান গভীর অর্থনৈতিক সংকট ও রাশিয়া– ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রিত্ব এমন কারও কাছে থাকা উচিত নয়, যাঁর প্রতি পার্লামেন্টের আস্থা নেই। সব কটি বিরোধী দলও একই দাবি জানিয়েছে। উপপ্রধানমন্ত্রী ডমিনিক রাবকে এ সময়ে দায়িত্ব চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথাও উঠেছে।

কনজারভেটিভ পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলের নেতা নির্বাচনে সব সদস্যের ভোট গ্রহণের বিধান আছে, যার আয়োজনে সময় প্রয়োজন এবং তা আগামী অক্টোবরে দলীয় সম্মেলনের আগে সম্ভব হবে না। তবে অন্তর্বর্তী সময়ে দলটির এমপিরা বিশেষ সভা করে ভারপ্রাপ্ত নেতা নির্বাচন করতে পারেন। সেই চেষ্টা যাঁরা করছেন, তাঁরা সফল হবেন কি না, তা আগামী সপ্তাহে বোঝা যাবে।

বিরোধী নেতা লেবার পার্টির প্রধান কিয়ের স্টার্মার জানিয়েছেন, বরিস জনসন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাওয়ার যে চেষ্টা করছেন, তাঁর বিরুদ্ধে তিনি পার্লামান্টে আস্থা ভোট চাইবেন।

ওই আস্থা ভোটে হেরে গেলে ব্রিটেনে নতুন নির্বাচন হবে। তবে কনজারভেটিভ পার্টির যাঁরা বরিসের পদত্যাগ চান, কিন্তু এখনই নির্বাচন চান না, তাঁদের সংখ্যা কত দাঁড়ায়, তার ওপরই নির্ভর করছে বিরোধীদের কৌশল সফল হবে কি না। ফলে অনেক অমীমাংসিত সাংবিধানিক প্রশ্ন দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। তবে কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে সক্ষম, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।