১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর এক চুক্তির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ‘আরমিসটিস’ (সংঘাতের অবসান) নামে পরিচিত ওই চুক্তি। আজ শতবর্ষ পূর্ণ করল শান্তি প্রতিষ্ঠার সেই ঐতিহাসিক দিনটি।
দেশে দেশে নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ওই যুদ্ধের অন্যতম রণক্ষেত্র ইউরোপের দেশগুলোয় প্রতিবছরই দিবসটি পালন করা হয়। তবে শতবর্ষ উপলক্ষে এবারের আয়োজন অন্যবারের তুলনায় বেশ আলাদা এবং ব্যাপক পরিসরে করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য বরাবরই বিশেষ মর্যাদায় আরমিসটিস ডে পালন করে। শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে চলতি বছরের শুরু থেকেই নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করছে ব্রিটিশরা।
ইউরোপ প্রান্তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় লড়াই ‘ব্যাটল অব সোম’। সেখানে ৭২ হাজার ৩৯৬ জন ব্রিটিশ-কমনওয়েলথ সেনা নিহত হন। তাঁদের মরদেহের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি, কোনো সমাধি নেই। নিখোঁজ সেই সেনাদের এবার অন্য রকমভাবে স্মরণ করছে যুক্তরাজ্য।
পূর্ব লন্ডনের কুইন এলিজাবেথ অলিম্পিক পার্কের খোলা ময়দানে প্রদর্শিত হচ্ছে সাদা কাফনে মোড়া ৭২ হাজার ৩৯৬টি মরদেহের প্রতিরূপ। নিরুদ্দেশ সেই সেনাদের স্মরণে এসব মূর্তি তৈরি করেছেন ভাস্কর রব হার্ড। দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি এই রেপলিকাগুলো তৈরি করতে তাঁর লেগেছে প্রায় পাঁচ বছর। গত বৃহস্পতিবার থেকে অলিম্পিক পার্কে এগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ-কমনওয়েলথ সৈন্যদের স্মরণে গতকাল শনিবার লন্ডনের রয়্যাল আলবার্ট হলে অনুষ্ঠিত হয় কনসার্ট। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথসহ রাজপরিবারের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এতে অংশ নেন। আগের দিন শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী মে ছুটে যান বেলজিয়ামে। সেখানে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ নিহত ব্রিটিশ সৈন্যের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তারপর চলে যান ফ্রান্সে। সেখানে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাধিস্থল পরিদর্শন করেন।
আরমিসটিস ডে সামনে রেখে কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই যুক্তরাজ্যের মানুষ ব্রিটিশ সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লাল রঙের পপি ফুল পরিধান করেন। পপি ফুল নিয়ে চলে নানা উদ্যাপন। তবে দিবসটি উপলক্ষে আজ হচ্ছে চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা।
শতবর্ষ পূর্তিতে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নানা বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অন্তত ১৫ লাখ সৈন্য ব্রিটিশদের পক্ষে লড়াই করেছিলেন। এঁদের মধ্যে চার লাখের অধিক ছিলেন মুসলিম।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের অবদান নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘মুসলিম এক্সপেরিয়েন্স’–এর হাইয়ান ভভ বিবিসিকে বলেন, কালের পরিক্রমায় মুসলিমদের অবদানকে ভুলতে বসেছে সবাই। বর্তমানে ইউরোপে মুসলিমবিদ্বেষ মোকাবিলায় ইউরোপের জন্য মুসলিমদের অতীত অবদানের কথা তুলে ধরা খুব জরুরি।
১৯১৪ সালের ২৮ জুন খুন হন তৎকালীন ‘অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান’ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর্চ ডিউক ফ্রানজ ফার্দিনান্দ। একজন সার্বীয় শিক্ষার্থী তাঁকে হত্যা করেন। ওই হত্যাকাণ্ডের এক মাসের মাথায় ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ‘অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি’। এ থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা।
এই যুদ্ধে একপক্ষে ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্য। এদের বলা হয় ‘দ্য সেন্ট্রাল পাওয়ারস’। আর অন্য পক্ষে ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, রোমানিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। এদের বলা হয় ‘দ্য অ্যালাইড পাওয়ারস’।
বিসিসির প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৯৭ লাখ সামরিক সদস্য নিহত হন। আর প্রায় এক কোটি বেসামরিক লোক মারা যান। এঁদের মধ্যে ‘দ্য অ্যালাইড পাওয়ারস’–এর সামরিক সদস্য নিহত হন ৫৭ লাখ। আর বেসামরিক লোক নিহত হন ৩৭ লাখ। অন্যদিকে, ‘দ্য সেন্ট্রাল পাওয়ারস’–এর সামরিক সদস্য নিহত হন ৪০ লাখ। আর বেসামরিক লোক নিহত হন ৩১ লাখ। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ৬০ লাখ সৈন্য ব্রিটিশ-কমনওয়েলথ বাহিনীতে যোগ দেন। তঁদের মধ্যে নিহত হন ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪২ জন। আর ব্রিটিশ বেসামরিক লোক নিহত হন প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার।
১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা কম্পিয়েনে জার্মানির আত্মসমর্পণ এবং ‘আরমিসটিস চুক্তি’ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ চার বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান হয়। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ গতকাল শনিবার ঐতিহাসিক সেই স্থান পরিদর্শন করেন।