আজ ২৫ অক্টোবর। ১৯৭২ সালের এই দিনে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন এস্থার দুফলো। সেই সূত্রে আজ তাঁর ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। ২০১৯ সালের নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর এখন সবাই জানেন যে ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম নারী, যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
এস্থার দুফলোর বিগত জন্মদিনের তুলনায় এবারের জন্মদিন অবশ্যই ভিন্ন। আগের চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ অভিনন্দনের বন্যা বইবে তাঁকে ঘিরে, ফুলে ফুলে উপচে পড়বে গৃহচত্বর। শুভেচ্ছা জানাতে আসবেন অনেক বিদগ্ধজন। ইতিমধ্যে ফরাসি অর্থমন্ত্রী নোবেল পাওয়ার এমন গৌরবের খবর শুনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছেন, ‘একটি ব্যতিক্রমী মেধাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম মেধাবী অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিবেচিত এমআইটির দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এস্থার দুফলো বিশ্বে নারীদের মধ্যে দ্বিতীয়, যিনি গুরুত্বপূর্ণ এ শাখায় এমন বিরল সম্মান পেলেন।
১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। সেই থেকে অর্ধ শতক পরে মার্কিন নাগরিক এলিনর অস্ট্রম (১৯৩৩-২০১২) প্রথম নারী, যিনি পুরুষদের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করে ২০০৯-এর অক্টোবরে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ পর্যন্ত মাত্র ৪ জন ফরাসি নারী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, ফ্যাশন, রুচি, বিলাস, স্বাধীনতা, সাম্য, ভালোবাসার এক রোমান্টিক দেশ ফ্রান্স। এরা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ এ পর্যন্ত ১৫টি নোবেল পুরস্কার মাথায় নিয়ে সাহিত্যের মাঠে একচেটিয়া দাপট দেখালেও অর্থনীতিতে মাত্র ৪টি পুরস্কার পেয়েছে। সে ৪ জনের মধ্যে একজন হলেন ড. এস্থার দুফলো।
এস্থার দুফলোর সঙ্গে আরও দুজনকে এমন সম্মানের ভাগীদার করা হয়েছে। এ দুজনের একজন হচ্ছেন তাঁর ডক্টরাল অধ্যয়ন এবং গবেষণার উপদেষ্টা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধও বটে। ২০১৫ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। আরেক বিজয়ী মাইকেল ক্রেমার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির অধ্যাপক।
‘আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি। সত্যি কথা বলতে কি, এত কম বয়সে নোবেল পাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি ভাবিনি’—পুরস্কার পাওয়ার খবর জেনে এভাবেই টেলিফোনে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তা সত্যি, এর আগে এই সম্মানটি যেসব অর্থনীতিবিদ যখন লাভ করেছেন, তত দিনে তাঁরা সবাই গড়ে তাঁদের জীবনের ৬০তম বসন্ত উদ্যাপন করে ফেলেছিলেন। আর সে হিসাবে অর্থনীতিতে নোবেল লরিয়েটদের মধ্যে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ।
বাবা মিশেল দুফলো একজন গণিতবিদ এবং মা ভায়োলিন দুফলো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ছোটবেলা কেটেছে প্যারিসের শহরতলিতে। এস্থার দুফলো ২২ বছর বয়সে ইতিহাস ও অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ফ্রান্সের প্রাচীন (স্থাপিত: ১৫৩০) এবং আজও অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ‘কলেজ দা ফ্রান্স’-এর পরিচালনা পর্ষদ তাঁকে সম্মানসূচক অধ্যাপক পদের জন্য নির্বাচিত করে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর। এত অল্প বয়সে তাঁর জন্য কলেজ দা ফ্রান্সের এই অধ্যাপকের পদ ছিল অনেক বেশি সম্মানের, যা অনেকেরই কল্পনার বাইরে। সেটা ছিল ২০০৯ সাল। সে বছর তিনি মর্যাদাপূর্ণ ‘জন বেটস ক্লার্ক’ পদক পেয়েছিলেন। পদকটি অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়স্ক অর্থনীতিবিদদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয়। তখনই অনেকে তাঁর মধ্যে একজন নোবেল লরিয়েটকে দেখতে পেয়েছিলেন। জাতীয় টেলিভিশনের এক জাঁদরেল সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি পুঁজিবাদের প্রতি আগ্রহ না দেখিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁর মেধা ও শক্তিকে সরাসরি কাজে লাগানোর কথা বলেছিলেন।
সে সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতের একটি অঞ্চলকে বেছে নিয়েছি। ভারতে কম্পিউটার ব্যবহার এখন একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য কম্পিউটারের বিকল্প নেই। বিষয়টা ঠিক তা নয়। লেখাপড়ায় সাহায্য করার জন্য আমরা কিছু স্কুলের ছাত্রছাত্রীর হাতে কম্পিউটার তুলে দিয়েছি। একই সঙ্গে কিছু ছাত্রছাত্রীকে কম্পিউটারের পরিবর্তে শিক্ষক দিয়ে লেখাপড়ায় সাহায্য করেছি। কম্পিউটারের সাহায্য নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা গণিতের ক্ষেত্রে কিছুটা ভালো ফল করলেও ততটা ভালো হয়নি, যা আমরা আশা করেছিলাম। অথচ একজন শিক্ষক দিয়ে তাদের সাহায্য করতে দশ গুণ কম খরচ হয়।’
একটা মাত্র উদাহরণ দিয়ে সাধারণের উদ্দেশে খুব সাদামাটাভাবে কথাগুলো বললেও যখন তিনি হলভর্তি হাজার গুণী বোদ্ধা শ্রোতার সামনে কম্পিত কণ্ঠে ফরাসি টানে চমৎকার ইংরেজিতে অবলীলায় দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রামের কথা বলেন, তখন মনে করিয়ে দেন, ‘প্রতিদিন মারা যায় ২৫ হাজার শিশু, যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে।’ তিনি যখন আর্দ্র অথচ দৃঢ় কণ্ঠে দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্ত পৃথিবী উপহার দেওয়ার কথা বলেন, তখন হাজার শ্রোতার উষ্ণ করতালি তাঁর কণ্ঠকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।
২০১৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন তিনি এবং সে বছরই বিশ্বের দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার জন্য অভিজিৎ ও এস্থার দুফলো যুগ্মভাবে ‘আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ গড়ে তুলেছিলেন। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ভারত আর কেনিয়া চষে বেড়িয়েছেন। তাঁদের পরীক্ষামূলক গবেষণাকেই সম্মান জানিয়েছে নোবেল কমিটি। কমিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাঁদের গবেষণা গোটা বিশ্বকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়ার নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে তাঁদের গবেষণাপদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম পাথেয় মডেল।
স্বামী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন ভারতীয়-আমেরিকান বাঙালি। তিনিও এমন পুরস্কার পেয়েছেন অর্থনীতিতে—চলতি বছরের নোবেলজয়ী হিসেবে। বন্দ্যোপাধ্যায়-দুফলো জুটি হলেন নোবেলের ইতিহাসে পঞ্চম দম্পতি। এ দম্পতির একটি কন্যা সন্তান আছে, ডাকনাম নোয়েমি। নোয়েমির নোবেল বিজয়ী মা জানান, যাতে করে বাংলা, ইংরেজি আর ফরাসিতে সহজেই উচ্চারণ করা যায়, তা বিবেচনায় রেখেই নামটি রাখা হয়েছে। শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় পেলেই তিনি পাহাড়-পর্বতের দিকে ছুটতেন। পাহাড়ের দুর্গম খাঁড়া পথ বেয়ে তর তর করে উঠে যাওয়া তাঁর পছন্দের স্পোর্টস। তা ছাড়া তিনি টেনিস খেলতেও ভালোবাসেন।
১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৫৩ বার এ পুরস্কার পেয়েছেন ৫২ জন নারী। এর মধ্যে মেরি কুরি একাই পেয়েছেন দুবার এবং তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম নারী। আর নারী-পুরুষ মিলিয়ে তিনিই এ পর্যন্ত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কিনা বিজ্ঞানের দুটি আলাদা শাখায় (পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। মেরি কুরির একটি নোটবই ছিল। রেডিয়াম আবিষ্কার আর এক্স-রে মানবকল্যাণে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, এসব নিয়ে সে নোটবইয়ে অনেক কিছু নোট করেছিলেন তিনি। তেজ বিকিরণকারী মানবকল্যাণের জীবন্ত প্রতীক তাঁর নোটবুকটি আজও তেজস্ক্রিয়। মেরি কুরির তেজে দীপ্ত হয়ে বিশ্বসভ্যতার আলোর পথের যাত্রী একজন এস্থার দুফলো নিশ্চয়ই পারবেন বিশ্বের কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। ড. এস্থার দুফলো একজন মা, একজন সত্যিকারের মানুষ—নোবেল পুরস্কার পাওয়া এই প্রথম ফরাসি নারীর জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা।
লেখক: ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত