রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুবাদে ইউক্রেনের বন্দর নগরী মারিউপোলের নাম এখন কমবেশি অনেকের জানা। পশ্চিমা গণমাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত মারিউপোল আর স্যাটেলাইটে গণকবরের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে বারবার। রুশ বার্তা সংস্থা আরটির খবর বলছে, গত এপ্রিল থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরছে মারিউপোলবাসী।
শহরটিতে নিযুক্ত রুশ সাংবাদিক আলেকজান্দ্রে উইগ্রেইজারের বয়ানে জানা যায়, মারিউপোলের রাস্তায় এখন দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের খোঁজে ব্যস্ত পথচারীদের। শিশুরা রাস্তায় হাসি, খেলায় মেতে থাকে। প্রেমিকেরা আবারও ফুলের তোড়া তুলে দিচ্ছেন প্রেমিকার হাতে। নারীরা হয়ে উঠছেন ফ্যাশন সচেতন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভবনগুলোর ভাঙা জানালার ওপাশ থেকে ভেসে আসে পিয়ানোর শব্দও।
আলেকজান্দ্রে উইগ্রেইজার বলেন, শহরে ব্যবসায়ী ও মানি চেঞ্জারদের সক্রিয়তা জানান দেয় মারিউপোলের অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে। গত মাস থেকে মারিউপোলের বাজারগুলো খুলতে শুরু করেছে। বিভিন্ন পণ্যও আমদানি করা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি পৌঁছেছে মানবিক ত্রাণ। শহরের বাসিন্দারা জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রিও করছেন।
মারিউপোল ঘুরে আলেকজান্দ্রে উইগ্রেইজার বলেন, অর্থনীতি সচল হওয়ার পাশাপাশি জীবনযাত্রাও হয়ে উঠছে স্বাভাবিক। প্রকৃতি ফিরছে স্বাভাবিক সৌন্দর্যে। ফুটছে সুবাসিত লাইলাক ফুল। তরুণ প্রেমিকদের দেখা গেছে লাইলাক ফুল পেড়ে বিক্রির জন্য তোড়া বানাতে। আর প্রেমিকারা হাসিমুখে সেই তোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুধু প্রেমিক–প্রেমিকারাই নন, বিস্ফোরণের শব্দ আর বিধ্বস্ত ভবনের মধ্য দিয়ে অনেক দম্পতিকেই হাসিমুখে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত মারিউপোলে পানির সংকট অনেকটাই কেটে গেছে বলছেন রুশ সাংবাদিক আলেকজান্দ্রে। যুদ্ধের সময় পানির অভাবে মারিউপোলের নারীরা শাল ও টুপি দিয়ে অপরিষ্কার চুল ঢেকে রাখতেন। এখন তাঁরা আবার পরিচ্ছন্ন হচ্ছেন। পোশাক–আশাকও অনেকটা পরিষ্কার। শুধু তা–ই নয়, নারীরা এখন আবার ফ্যাশন সচেতন।
এপ্রিলে মারিউপোলের রাস্তাগুলোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের কাজে ব৵স্ত মানুষদের হেঁটে বেড়াতে দেখা গেছে। কেউ হয়তো পানির বোতলভর্তি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আবার মানবিক ত্রাণবোঝাই ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় দিবসে শিশুরা রাস্তায় নেমে খেলা করেছে। সামরিক গাড়িতে উঠে তাদের আনন্দ করতে দেখা গেছে। বাইসাইকেল ও স্কুটার নিয়ে খেলা করতে দেখা গেছে শিশুদের।
আলেকজান্দ্রে আরও বলেন, যুদ্ধ তো পুরোপুরি শেষ হয়নি। শিশুরা যখন মারিউপোলের রাস্তায় আনন্দ করছিল, তখন অদূরেই আজভস্তাল কারখানায় বোমা ও গুলির শব্দ শোনা গেছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের সবশেষ সেনাদল আজভস্তাল কারখানায় অস্ত্রসমর্পণ করে। এরপর তারা আত্মসমর্পণ করে। এরপর পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বলছেন এই রুশ সাংবাদিক।
রুশ সাংবাদিক আলেকজান্দ্রে আরও বলেন, শুধু মারিউপোলের সাধারণ মানুষই নয়, সেখানে নিযুক্ত রুশ সেনারাও এখন অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন। তাই রুশ বাহিনীর এক ডেপুটি কমান্ডার রুশ সাংবাদিক আলেকজান্দ্রের কাছে রাতের আকাশের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেন। ওই ডেপুটি কমান্ডার রুশ সাংবাদিককে মারিউপোলের রাতের আকাশের ছায়াপথ ও তারায় ভরা আকাশের সৌন্দর্যের কথা বলেন। এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় আগে মারিউপোলের কিছু বাড়িতেও বিদ্যুতের আলো ফিরে এসেছে।
এ তো গেল শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কথা। রুশ সাংবাদিক আলেকজান্দ্রে বলছেন, মারিউপোলের হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতিও তিনি অনেকটা স্বাভাবিক দেখেছেন। অস্ত্রোপচারের পর কয়েকজন চিকিৎসককে দেখা গেছে, বাসের সময়সূচি নিয়ে আলোচনা করতে। নার্সরা দুধের দাম নিয়ে কথা বলছিলেন।
রুশ সাংবাদিক আলেকজান্দ্রে বলেন, মারিউপোলের জীবনযাত্রা এতটাই স্বাভাবিক যে প্রথমবারের মতো গানের শব্দ শুনেছেন তিনি। এক রুশ সেনাকে দেখা গেছে তাঁর খোলা গাড়িতে চড়ে গান গাইতে। তিনি বলেন, পথচারীদেরও গল্পে মশগুল থাকতে দেখা গেছে। আকাশছোঁয়া ভবনগুলোর বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে বাসনের শব্দ, ফোনে কথা বলা ও হাসি–গল্পের শব্দ শোনা যায়। যুদ্ধে ভেঙে যাওয়া একটা জানালার কাচের ওপাশ থেকে পিয়ানো বাজানোর শব্দও কানে এসেছে।
তবে এত তাড়াতাড়ি যুদ্ধের সব ছাপ মুছে ফেলা যায় না। মারিউপোলের রাস্তাগুলো এখনো ধোঁয়া আর তৈলাক্ত পদার্থে ঢাকা। ভবনগুলোয় যুদ্ধের ছাপ। কিছু ভবনের পাশে বেড়া দেওয়া জায়গায় রয়েছে নতুন কবর। অনেক জায়গা থেকে এখনো ভেসে আসে শবের গন্ধ। সেসব মনে করিয়ে দেয় ক দিন আগেও কী ভয়াবহতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে মারিউপোলবাসীকে।