রাশিয়ার রাজধানীর মস্কোর সঙ্গে মিল রেখে যুদ্ধজাহাজটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মস্কোভা’। কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবহরের গর্ব হিসেবে বিবেচনা করা হতো যুদ্ধজাহাজটিকে। সোভিয়েত আমলে নির্মিত এই যুদ্ধজাহাজ জর্জিয়া ও সিরিয়া যুদ্ধের পর ইউক্রেন যুদ্ধেও ভূমিকা রাখছিল। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের সময়ও জাহাজটির তত্পরতা দেখা গেছে। শান্তিপূর্ণ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও সহায়তা করেছে এই যুদ্ধজাহাজ।
গতকাল বৃহস্পতিবার কৃষ্ণসাগরে ডুবে যায় মস্কোভা। রাশিয়া বলেছে, জাহাজটিতে আগুন লাগে। পরে সেটি তীরের দিকে টেনে নেওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। তবে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলছে, জাহাজটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল তারা।
ইউক্রেনে রুশ অভিযান যখন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তখন রাশিয়ার এই যুদ্ধজাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, মস্কোভার মজুত থাকা গোলাবারুদে বিস্ফোরণ থেকে আগুন ধরে যায়। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটি টেনে বন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ সময় ঝোড়ো আবহাওয়ার কবলে পড়ে জাহাজটি ডুবে যায়।
তবে ভিন্ন কথা বলছে ইউক্রেন। দেশটির একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজটিতে ‘নেপচুন’ নামের একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। ইউক্রেনের এই দাবির পক্ষে কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রও।
আগুন লাগার সময় মস্কোভা যুদ্ধজাহাজটি ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরের কাছাকাছি কৃষ্ণসাগরের কোথাও অবস্থান করছিল। এ সময় সেটিতে ৫০০ জনের মতো নাবিক ছিলেন।
১২ হাজার ৫০০ টন ওজনের মস্কোভা মিসাইল ক্রুসার শ্রেণির একটি যুদ্ধজাহাজ। সেটি সাজানো ছিল জাহাজবিধ্বংসী এবং ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে। এ ধরনের একটি জাহাজই কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন ছিল। একই শ্রেণির অপর দুটি জাহাজ—‘মার্শাল উস্তিনভ’ ও ‘ভারইয়াগ’ মোতায়েন রয়েছে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইওডব্লিউ) বলছে, ইউক্রেন যে যুদ্ধজাহাজটি ডুবিয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে যেভাবেই জাহাজটি ডুবে যাক না কেন, তা যুদ্ধ নিয়ে ইউক্রেনের গলা উঁচু করবে। অপর দিকে জাহাজডুবির ঘটনা রাশিয়ার মনোবল ভেঙে দেওয়ার মতো বিষয়।
তবে সামরিক দিক দিয়ে মস্কোভা–ডুবি খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। আইওডব্লিউ বলছে, যুদ্ধজাহাজটি থেকে সম্ভবত ইউক্রেনের নানা ঘাঁটিতে ক্যালিবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হতো। তবে দেশটিতে রুশ বাহিনীর চালানো বিমান হামলা ও ভূমি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তুলনায় তা কম। তাই এই যুদ্ধজাহাজডুবি রুশ বাহিনীর জন্য খুব বড় ধাক্কা হবে বলে মনে হয় না।
রাশিয়ার সামরিক বিশ্লেষকেরাও রুশ নৌবাহিনীর জাহাজটির ডুবে যাওয়াকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁদেরই একজন আলেকসান্দার খ্রামচিখিন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘জাহাজটি আসলে অনেক পুরোনো। পাঁচ বছর ধরেই সেটিকে অবসরে পাঠানোর পরিকল্পনা চলছিল।’
আলেকসান্দার খ্রামচিখিন বলেন, যুদ্ধের চেয়ে মর্যাদার দিক দিয়ে জাহাজটির গুরুত্ব বেশি। চলমান অভিযানে সেটির করার কিছুই ছিল না। যুদ্ধজাহাজটির ডুবে যাওয়া যুদ্ধে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
গত শতকের সত্তরের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরিগুলো নির্মাণের পাল্টা হিসেবে বেশ কিছু যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারই একটি ছিল মস্কোভা। এ ছাড়া সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজগুলোকে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে রক্ষা করাও ছিল মস্কোভা নির্মাণের একটি উদ্দেশ্য। ওই জাহাজগুলোর ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল ‘বিমানবাহী রণতরি ধ্বংসকারী’।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেনসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৯ সালে জুলাইয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেনের মিকোলেইভের একটি শিপইয়ার্ড থেকে ‘স্লাভা’ নামে যুদ্ধজাহাজটি যাত্রা শুরু করে। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে এই যুদ্ধজাহাজ সোভিয়েত নৌবাহিনীতে কমিশনিং করা হয়। সে সময় কৃষ্ণসাগরে অবস্থান করা দেশটির নৌবহরের নেতৃত্বে ছিল এই যুদ্ধজাহাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের সময় পারমাণবিক অস্ত্রের পাশাপাশি কামান, টর্পেডো ও মর্টার দিয়ে সাজানো ছিল স্লাভা। হেলিকপ্টার ওঠানামার জন্য ছিল একটি হেলিপ্যাড।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গত শতকের নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধজাহাজটি মেরামত করে রাশিয়া। ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পর সেটির নাম দেওয়া হয় মস্কোভা। এরপর এই যুদ্ধজাহাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের স্বাগত জানান পুতিন। ২০০৩ সালে যুদ্ধজাহাজটিতে স্বাগত জানানো হয় ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনিকে।
২০০৮ সালে রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের সময় কৃষ্ণসাগরে অভিযান চালায় মস্কোভা। জাহাজটি থেকে সে সময় হামলা চালানো হয়েছিল বলে জানায় জর্জিয়া সরকার। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে রাশিয়ার অভিযানে অংশ নিয়েছিল মস্কোভা। সিরিয়া যুদ্ধেও রুশ বাহিনীকে বিমান হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে সুরক্ষা দিতে মোতায়েন করা হয় যুদ্ধজাহাজটি। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর স্নেক আইল্যান্ডে হামলা চালানো হয়েছিল এই যুদ্ধজাহাজ থেকে।