নাভালনিকে আটক করার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ।
নাভালনিকে আটক করার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ।

পুতিনবিরোধী বিক্ষোভ জোরদার হচ্ছে

রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় চার হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। সেখানে আবারও বিক্ষোভ দানা বাঁধছে।

ছোট্ট একটি পুলিশ ভ্যান। তার মধ্যেই গাদাগাদি করে দাঁড়ানো ১৭ জন মানুষ। সারা রাত তাঁদের এভাবেই দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়েছে। কারণ, এ মুহূর্তে মস্কোর বন্দিশিবিরগুলো ভরা। সেখানে বন্দী রাখার কোনো জায়গা খালি নেই। ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো ফিলিপ কুজনেতসোভের মতো অনেকের এই পরিণতি।

গত সপ্তাহে রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় চার হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ফিলিপ একজন। রোববার দেশটিতে আরও বড় বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

নাভালনির ডাকে ২৩ জানুয়ারি তাঁর মুক্তির দাবিতে হাজারো মানুষ রাশিয়ার রাজপথে নামেন। রাজধানী মস্কোসহ দেশটির অন্তত ১০০টি শহর-নগরে বিক্ষোভে শামিল হন হাজারো মানুষ।

গত বুধবার ফিলিপ পুলিশ ভ্যানের পেছন থেকে বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। একজনকে সব সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, যাতে অন্যজন একটু জায়গা পেতে পারেন।’ তাঁদের যে পুলিশ ভ্যানে আটকে রাখা হয়েছে, সেটি পুরোনো আমলের চারপাশে লোহার বেড়া দেওয়া একটি গাড়ি।

বিক্ষোভের প্রেক্ষাপট

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত অ্যালেক্সি নাভালনি। গত বছরের আগস্টে সাইবেরিয়ার টমসক শহর থেকে মস্কোয় যাওয়ার পথে উড়োজাহাজে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে প্রথমে অভিযোগ করেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা। পরে জার্মানির চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নাভালনি ও তাঁর সহযোগীদের অভিযোগ, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশেই তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে নাভালনিকে বিষ প্রয়োগের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ক্রেমলিন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনি।

চলতি মাসের ১৭ তারিখ নাভালনি উড়োজাহাজে করে জার্মানির বার্লিন থেকে রাশিয়ার মস্কোয় পা রাখামাত্র আটক হন। ২০১৪ সালের একটি অর্থ আত্মসাৎ মামলায় স্থগিত দণ্ডের প্যারোলের শর্ত ভাঙার অভিযোগে তাঁকে আটক করা হয়। পরে পুলিশ থানাতেই আদালত বসিয়ে তাঁকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেওয়া হয়।

এরপর নাভালনির ডাকে গত শনিবার তাঁর মুক্তির দাবিতে হাজারো মানুষ রাশিয়ার রাজপথে নামেন। রাজধানী মস্কোসহ দেশটির অন্তত ১০০টি শহর-নগরে বিক্ষোভে শামিল হন হাজারো মানুষ। এরই জেরে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

যেকোনো সময় যে কেউ আটক হতে পারেন

বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় ফিলিপ কুজনেতসোভকে গত সোমবার ১০ দিনের কারাদণ্ড দেন মস্কোর একজন বিচারক। কিন্তু তাঁর জন্য শহরের কারাগারে জায়গা খুঁজতেই দুদিন পার হয়ে যায়। মস্কোর একটি বন্দিশিবিরের সামনে তাঁর মতো অনেককে অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। খাবার বলতে কপালে জুটেছে কেবল স্বেচ্ছাসেবকদের দেওয়া স্যান্ডউইচ।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

ফিলিপ ছোট্ট একটি ব্যবসা করেন। তিনি নাভালনির সমর্থক বা অনুসারী নন। কিন্তু তাঁর মতো নাগরিকদের প্রতি যেভাবে আচরণ করা হয়, তাতে বিরক্ত তিনি। ফিলিপ বলেন, ‘তারা যে কাউকে অহেতুক শাস্তি দেয়। এর অর্থ দাঁড়ায় যে কেউ পরবর্তী শিকার হতে পারে। এমনকি এর মধ্যে আমিও পড়তে পারি।’

মস্কোর পুশকিন স্কয়ারে জড়ো হওয়া কয়েকজন বিক্ষোভকারী নাভালনির বিষ প্রয়োগের ঘটনায় ক্ষুব্ধ। তবে তাঁরা বলেছেন, তাঁরা আরও বেশি মর্মাহত হয়েছেন নাভালনির দেশে ফেরার পর আটক হওয়ার ঘটনায়। তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো মামলা নিয়েও অভিযোগ করছেন কেউ কেউ।

আমরা এখন অশান্ত সময় কাটাচ্ছি। তাই শনিবারের ওই বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত ও কঠিন।
একেতারিনা শুলম্যান , রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মস্কোয় বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মানুষদের মধ্যে ৪২ শতাংশ প্রথমবারের মতো পথে নেমেছেন। এ ছাড়া এবারের বিক্ষোভ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নজিরবিহীনভাবেও।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একেতারিনা শুলম্যান বলেন, মস্কোয় বিক্ষোভকারীদের নিরাপত্তা আছে। কেউ চাকরি হারালে তাঁর কাজের সুযোগ আছে। কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে সে সুবিধা অনেক কম।

পুতিনের দুর্নীতির ভিডিও

নাভালনির সমর্থকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের শহর ভ্লাদিভস্টকে গত শনিবার যত বড় বিক্ষোভ চোখে পড়েছে, তেমন বিক্ষোভ গত এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে দেখা যায়নি।

নাভালনির পক্ষের এ বিক্ষোভের স্থানীয় সমন্বয়কারী ক্যাটেরিনা ওস্তাপেনকো বলেন, তিনি প্রথমে বিক্ষোভে অংশ নেননি। তারপরও বিক্ষোভের এক দিন আগেই পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু নাভালনির প্রচার করা ভিডিওতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন।

মস্কোয় বিক্ষোভে সড়কে নেমেছেন অনেকে

ওই ভিডিওতে পুতিনের দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, পুতিন কৃষ্ণসাগরে গোপন এক প্রাসাদ তৈরি করেছেন, যাতে অ্যাকোয়া ডিস্কো ও পোল ড্যান্সিংয়ের মতো নানা সুবিধা রয়েছে।

ওস্তাপেনকো বলেন, রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের অনেক বেশি ক্ষোভ রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের কাছে অর্থ নেই, অথচ পুতিনের অনেক অর্থ। জনগণের করের টাকায় রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলেছেন পুতিন।

ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য গেলেনজিকের ওই বিশাল সম্পদের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের মগজ ধোলাই করতে ওই দুর্বল ভিডিও চিত্র দেখানো হচ্ছে। ইউটিউবে ওই ভিডিও ১০ কোটিবার দেখা হয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একাতেরিনা বলেন, অনেক মানুষ ভিডিওটি দেখেছেন। এতে বিক্ষোভ–পরবর্তী গভীর অসন্তোষ প্রতিফলিত হয়। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ায় লকডাউন পদক্ষেপ, ওই সময়ে মানুষের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের পাশাপাশি চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং আয় কমে যাওয়ার বিষয় ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে। দুই বছর আগে পুতিনের পুনর্নির্বাচনের সময়ের তুলনায় এখন তাঁর আস্থার রেটিং অনেক কমে গেছে।
একাতেরিনা বলেন, ‘আমরা এখন অশান্ত সময় কাটাচ্ছি। তাই শনিবারের ওই বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত ও কঠিন।’

ওই দিন হাজারো বিক্ষোভকারীকে আটকসহ জরিমানা, কারাদণ্ডের পাশাপাশি কর্মকর্তারা এখন নাভালনির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের পেছনে লেগেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন নাভালনির ভাই, চিকিৎসক ও তাঁর দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার আইনজীবী।

মস্কোজুড়ে ধরপাকড়

মস্কোয় নাভালনির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ফ্ল্যাট ও অফিসে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। করোনা মহামারির মধ্যে বিক্ষোভ ডাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার আদালত ওই তিনজনকে দুই মাসের জন্য গৃহবন্দী রাখার আদেশ দিয়েছেন। তদন্ত চলাকালে তাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র অবশ্য দাবি করেছেন, এ মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা কেবল তাঁদের কাজ করছেন।
তবে বিক্ষোভকারীরা বন্দীদের মুক্তি দাবি করছেন।

পুতিন এই প্রাসাদ তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন নাভালনি

‘বিক্ষোভ চালাতে হবে’

গত সপ্তাহের ধরপাকড়ের ফলে এ সপ্তাহের বিক্ষোভে জমায়েত কম হতে পারে। সাধারণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধেও ফৌজদারি মামলা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর সহিংসতা ও গুন্ডামির অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। তবে অনেকেই এসবের তোয়াক্কা না করেই বিক্ষোভ করতে চাইছেন।

গত সপ্তাহে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ড্যানিয়া বলেন, ‘আমরা একটি সমস্যার কথা বলছি। আমাদের যেভাবে শাসন করা হচ্ছে, তার কথা বলছি। আমরা ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য বিক্ষোভ করছি।’

ড্যানিয়ার বন্ধু কিরিল বলেন, পুলিশ যখন ব্যাটন হাতে ছুটে এসে তাঁদের মারতে শুরু করেছিল, তখনো তাঁদের গ্রুপ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি বলেন, ‘আমি নাভালনির সরাসরি সমর্থক নই। তবে তাঁর প্রতি আচরণকে “অবৈধ” মনে করি। প্রিয় দেশের নাগরিক হিসেবে ও দেশকে আরও ভালো করার প্রত্যয়ে আমরা বিক্ষোভ করছি।’

আগামী বিক্ষোভে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারবেন না ফিলিপ কুজনেতসোভ। তাঁকে আরও কয়েক দিন বন্দিশিবিরে কাটাতে হবে। তিনি শুক্রবার এক খুদে বার্তায় বলেন, তাঁদের পুলিশ ভ্যানে করে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ৩১ জানুয়ারির বিক্ষোভকারীদের রাখতে নতুন করে জায়গা খালি করছে পুলিশ। ১০০ কিলোমিটার দূরে শহরের বাইরে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য নির্মিত বন্দিশিবির তাঁদের ঠিকানা হচ্ছে।