রাশিয়ার ওপর যত নিষেধাজ্ঞা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

ইউক্রেনে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত দুই অঞ্চলকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে তিনি রুশ সেনা পাঠানোর নির্দেশও দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ মিত্রদেশগুলো। আর এ ধারাবাহিকতায় আরও নিষেধাজ্ঞা আসবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। খবর বিবিসির।

বেশ আগে থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে মস্কো। পশ্চিমা দেশগুলো দাবি করে আসছিল, দেশটিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। এমনটি হলে কঠোর নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি এসেছিল দেশগুলো থেকে।

নিষেধাজ্ঞা আদতে কী?

নিষেধাজ্ঞাকে একধরনের শাস্তি বলা চলে। কোনো দেশ আগ্রাসী আচরণ করলে বা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের মতো কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে ওই দেশের ওপর অন্য কোনো দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রায়ই একটি দেশের অর্থনীতি কিংবা শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদের মতো নাগরিকদের আর্থিক অবস্থার ওপর আঘাত হানতে জারি করা হয়। এর মধ্যে থাকতে পারে নির্দিষ্ট কোনো দেশে ভ্রমণ বিধিনিষেধ থেকে শুরু করে সমরাস্ত্রসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাও।

যেসব নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে রাশিয়া

পুতিন ইউক্রেনের বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়ার পর রাশিয়ার ওপর নানা দেশ ও অঞ্চল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ার ২৭ ব্যক্তি ও সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
ইউরোপের মূলধন বাজারে রাশিয়ার কর্মকাণ্ড সীমিত করতেও পদক্ষেপ নিচ্ছে ইইউ। ইইউর ব্যাংকগুলোতে থাকা দেশটির তহবিল আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি ইইউর সঙ্গে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা আসছে। রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ—ডুমার ৩৫১ সদস্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার নিশানায় পড়েছেন।

রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এসেছে গতকাল মঙ্গলবার। দেশটির ভিইবি ব্যাংক ও সামরিক বাহিনীর ব্যাংক প্রোমসভায়াজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রোমসভায়াজ ব্যাংক বিভিন্ন সামরিক চুক্তিতে কাজ করে থাকে। নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, ব্যাংক দুটি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা চালাতে পারবে না। পাশাপাশি মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়বে তারা।

এ ছাড়া রুশ ধনকুবের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন না। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ওই ব্যক্তিদের সম্পদ জব্দ করা হবে।

রাশিয়া দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়ার পর সেখানে মার্কিনিদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরও নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা হলে আরও ব্যাপক আকারে নিষেধাজ্ঞা আসবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে হোয়াইট হাউস।

এদিকে রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংক ও তিন ধনকুবের ব্যবসায়ীর ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তবে এতে সন্তুষ্ট নন দেশটির অনেক পার্লামেন্ট সদস্য। নিষেধাজ্ঞার পরিসর আরও বড় হওয়া উচিত ছিল বলে সরকারকে জানিয়েছেন তাঁরা। যদিও বরিস জনসন বলেছেন, ‘এটি প্রথম ধাপ। আরও নিষেধাজ্ঞা আমাদের হাতে প্রস্তুত আছে।’

নিষেধাজ্ঞা জারি করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেছেন, তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের কর্মকর্তাদের ভিসা প্রদান বন্ধ রাখবে দেশটি। রাশিয়ার সুনির্দিষ্ট কিছু লোকের জাপান ভ্রমণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বাইরে তাঁদের সম্পদ টোকিও জব্দ করবে।

এ ছাড়া জাপানে রাশিয়ার সরকারি বন্ড বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা উল্লেখ করে ফুমিও কিশিদা বলেন, নিষেধাজ্ঞার বিস্তারিত আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ঠিক করে নেওয়া হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের মধ্যে নর্ডস্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলত্জ। রাশিয়া থেকে জার্মানিতে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করতে এ প্রকল্প নিয়ে কথা চলছিল দেশ দুটির মধ্যে।
কানাডাও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের সঙ্গে কোনো আর্থিক লেনদেন করতে পারবেন না দেশটির নাগরিকেরা। অঞ্চল দুটিকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে ভোট দেওয়া রুশ পার্লামেন্ট সদস্যরা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন। কানাডার কালোতালিকায় পড়বে রাশিয়ার দুটি রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকও।

আরও যেসব নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি নিয়েছে পশ্চিমারা, পুতিনের নতুন পদক্ষেপের পর তার আংশিক মাত্র আরোপ করা হয়েছে। রাশিয়া যদি আদতেই হামলা চালায়, তাহলে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আসবে। সেগুলোর মধ্যে থাকতে পারে—

১. রাশিয়ার জন্য সুইফট সেবা বন্ধ রাখা

সুইফট হলো বিশ্বের নানা প্রান্তের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লেনদেনের কাজে ব্যবহৃত একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক। রাশিয়াকে সুইফট সেবার বাইরে রাখতে পদক্ষেপ নিতে পারে পশ্চিমা বিশ্ব।

এমন নিষেধাজ্ঞা এলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর জন্য দেশের বাইরে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। তবে এর উল্টো প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো দেশগুলোর ওপর। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে এসব দেশের ব্যাংকগুলোর ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে।

২. রাশিয়ার মার্কিন ডলার ব্যবহারে বাধা

আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রাশিয়া মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে পারবে না—এমন নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা কোনো প্রতিষ্ঠান ডলারে লেনদেন করলে সাজার মুখে পড়বে।

ডলারে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা এলে রাশিয়ার অর্থনীতি বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। কারণ, দেশটি থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস ডলারের বিনিময়ে রপ্তানি করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত রাশিয়ার অন্য খাতগুলোতেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য এমন নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানিকারী ইউরোপীয় দেশগুলোতেও সংকট দেখা দিতে পারে।

৩. রাশিয়ায় প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি বন্ধ

রাশিয়ায় মূল প্রযুক্তিপণ্যগুলোর রপ্তানি বন্ধ করতে পারে পশ্চিমা দেশগুলো। এসব পণ্যের মধ্যে থাকতে পারে সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোচিপ। গাড়ি থেকে শুরু করে স্মার্টফোন সবকিছু তৈরি করতেই প্রয়োজন এই মাইক্রোচিপের।

প্রযুক্তিপণ্যগুলো হাতে না পেলে যেমন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ গবেষণা খাত ক্ষতির মুখে পড়বে, তেমনই ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। একই সঙ্গে রাশিয়ায় এসব পণ্য রপ্তানিকারী দেশগুলোর ওপরও প্রভাব আসবে।

৪. রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি বন্ধ

প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল রপ্তানির ওপর রাশিয়ার অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে গাজপ্রম ও রসনেফটের মতো দেশটির বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তেল ও গ্যাস কেনা বন্ধ করতে পারে পশ্চিমারা।

রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করলে ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে, দেখা দিতে পারে তেলের সংকট। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে জার্মানি। রাশিয়া থেকে আমদানি করা গ্যাসেই দেশটির তিন ভাগের একভাগ চাহিদা মেটে।
৫. রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে কালোতালিকায় ফেলা

রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে কালোতালিকায় ফেলতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এতে করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক লেনদেন করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়বে। অবশ্য এসব ব্যাংকে যেসব পশ্চিমা বিনিয়োগকারীর অর্থ রয়েছে তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

মার্কিন ও ইউরোপীয় কূটনীতিকেরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলো এ পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, সে বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ নয়। বেশ কিছু দেশের রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে হাঙ্গেরি, ইতালি ও অস্ট্রিয়া। দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞার পথে হাঁটবে না।