রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে যেসব পণ্যের সরবরাহ ঝুঁকিতে পড়বে

রাশিয়া সীমান্তে টহল দিচ্ছেন ইউক্রেনের এক সেনা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনা মোতায়েন ঘিরে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা চরমে। এমন পরিস্থিতিতে মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির একের পর এক হুঁশিয়ারি আসছে। নিষেধাজ্ঞা এলে দেশটির নানা পণ্যের সরবরাহ ও রপ্তানি ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।  

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দাবি, ইউক্রেনে হামলা চালাতেই সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে ক্রেমলিন। এর জেরেই এসেছে নিষেধাজ্ঞার হুমকি। তবে রাশিয়া বলে আসছে, ইউক্রেনে হামলার কোনো ইচ্ছা নেই তাদের।

এদিকে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কার মুখে এর মধ্যেই নিকেল ও অ্যালুমিনিয়ামের দাম কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। রাশিয়ার প্রধান প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে:

অ্যালুমিনিয়াম

২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশপন্থী সরকারের পতনের পর দেশটির নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। এর জের ধরে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে এখন পর্যন্ত এসব নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েনি রাশিয়ার ধাতু নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

তবে ব্যতিক্রম রুশ প্রতিষ্ঠান ‘রুসাল’। চীনের বাইরে সবচেয়ে বড় অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটি। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের শুরু পর্যন্ত রুসালের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র।

এরপর ২০২১ সালের হিসাব বলছে, বছরটিতে ৩৮ লাখ টন অ্যালুমিনিয়াম উত্পাদন করে রুসাল। বিশ্বে সে বছর উত্পাদিত মোট অ্যালুমিনিয়ামের প্রায় ৬ শতাংশই এসেছিল সেখান থেকে। প্রতিষ্ঠানটির বড় বাজার রয়েছে ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায়।

কোবাল্ট

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ হাজার ৬০০ টন কোবাল্ট উত্পাদন করেছে রাশিয়া, যা বিশ্বের মোট উত্পাদনের ৪ শতাংশের বেশি।

ধাতুটি উত্পাদনে বিশ্বে রাশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথমে রয়েছে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র। গত বছর দেশটি ১ লাখ ২০ হাজার টন কোবাল্ট উত্পাদন করে।

রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় কোবাল্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘নরনিকেল’। ২০২১ সালে ৫ হাজার টন কোবাল্ট বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর বেশির ভাগই যায় ইউরোপের দেশগুলোতে।

তামা

তামা উত্পাদনেও বেশ এগিয়ে রয়েছে রাশিয়া। গত বছরে ৯ লাখ ২০ হাজার টন পরিশোধিত তামা উত্পাদন করেছে দেশটি, যা বিশ্বের মোট উত্পাদনের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৪ লাখ ৬ হাজার ৮৪১ টন তামাই নরনিকেল উত্পাদন করেছে বলে জানিয়েছে ইউএসজিএস।

নরনিকেল ছাড়াও রাশিয়ার বড় তামা উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইউএমএমসি ও রাশিয়ান কপার কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেশির ভাগ তামা যায় ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারগুলোতে।

নিকেল

নিকেল উত্পাদনে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে রুশ প্রতিষ্ঠান নরনিকেল। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬ টন পরিশোধিত নিকেল রপ্তানি করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এসব নিকেল বিক্রি করে তারা।

প্যালাডিয়াম ও প্লাটিনাম

নিকেলের পাশাপাশি প্যালাডিয়াম উত্পাদনেও বিশ্বে ১ নম্বরে রয়েছে রাশিয়ার নরনিকেল। প্লাটিনামের বড় উত্পাদনকারীও তারা। গত বছরে প্রতিষ্ঠানটি ২৬ লাখ ট্রয় আউন্স প্যালাডিয়াম উত্পাদন করে, যা বিশ্বের খনিজ উত্পাদনের ৪০ শতাংশ। পাশাপাশি ৬ লাখ ৪১ হাজার আউন্স প্লাটিনাম উত্পাদন করেছে নরনিকেল। এই পরিমাণ মোট খনিজ উত্পাদনের ১০ শতাংশ।

সোনা

অস্ট্রেলিয়া ও চীনের পরেই সোনা উত্পাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। বিশ্বে সোনার খনিজ উত্পাদনের ১০ শতাংশই আসে দেশটি থেকে। রাশিয়ার প্রধান সোনা উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পলিয়াস’ ও ‘পলিমেটাল’।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তোলিত সোনা প্রথমে রাশিয়ার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে। সেখান থেকে রপ্তানি হয় বাইরের বিভিন্ন দেশে।

ইস্পাত

ওয়ার্ল্ড স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে রাশিয়া বিশ্বের মোট ইস্পাতের ৪ শতাংশ উত্পাদন করেছে, যার পরিমাণ ৭ কোটি ৬০ লাখ টন। দেশটির প্রধান ইস্পাত উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে সেভারস্টাল, এনএলএমকে, ইভরাজ, এমএমকে ও মেকেল। তাদের উত্পাদিত প্রায় অর্ধেক ইস্পাত রপ্তানি করা হয় ইউরোপে।

হিরে

অমসৃণ হিরে উত্পাদনের বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ‘আলরোসা’। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৩ কোটি ২৪ লাখ ক্যারেট হিরে উত্তোলন করে। এটি বিশ্বের মোট উত্তোলিত হিরের প্রায় ৩০ শতাংশ। রাশিয়া থেকে উত্পাদিত হিরের বেশির ভাগই যায় বেলজিয়াম, ভরত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

সার

পটাশ, ফসফেট ও নাইট্রোজেন রয়েছে, এমন সারের বড় উত্পাদনকারী রাশিয়া। প্রতিবছর দেশটিতে ৫ কোটি টনের বেশি এসব সার উত্পাদন করা হয়, যা বিশ্বের মোট উত্পাদনের ১৩ শতাংশ।

ফসঅ্যাগ্রো, উরালকেম, উরালকালি, অ্যাক্রন ও ইউরোকেম রাশিয়ার বড় সার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ব্রাজিলে সার রপ্তানি করে তারা।

গম

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম উত্পাদনকারী দেশ রাশিয়া। গত বছরে দেশটিতে ৭ কোটি ৬০ লাখ টন গম উত্পাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জুন-জুলাই মৌসুমে ৩ কোটি ৫০ লাখ টন গম রপ্তানি করবে রাশিয়া। এসব গমের প্রধান ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক ও মিসর।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে তা কৃষ্ণ সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই পথ দিয়েই মূলত দেশ দুটি থেকে গম রপ্তানি হয়ে থাকে। ফলে যুদ্ধ বাধলে হুমকির মুখে পড়তে পারে রপ্তানি।