রাশিয়ার আগ্রাসনকে যেভাবে দেখছে দেশটির তরুণ প্রজন্ম

রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত মারিউপোলের শিশু হাসপাতাল
ফাইল ছবি : রয়টার্স

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে এ অভিযান শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমারা পুতিন, তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরসহ দেশটির ওপর তিন হাজারের বেশি অবরোধ দিয়েছে। এসব অবরোধ মূলত আর্থিক। এতে রাশিয়ার অর্থনীতি কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। অন্যদিকে রণাঙ্গনেও তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে অনেকটাই দূরে। শুরুতে যতটা সহজে কিয়েভের পতন ঘটানো সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছিল, তা হয়নি।

এখন পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়ার অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে না ইউক্রেন। ইউক্রেন আবার দায়ী করছে রুশ প্রেসিডেন্টকে।

বলা হচ্ছে, জরিপে দেখা গেছে, রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষই রাশিয়ার পক্ষে। কিন্তু এ জরিপ কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া যখন ‘যুদ্ধ’ শব্দটি উচ্চারণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে। এ অবস্থায় রাশিয়ার তরুণ প্রজন্ম এ আগ্রাসন কীভাবে দেখছে, তা জানতে পাঁচজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা। নিরাপত্তার স্বার্থে সবার ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

আমরা কেউই যুদ্ধ চাই না

ইউক্রেনে রুশ অভিযানের বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিক্ষোভ চলছে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসেও হাজারো মানুষ যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ করেন

মস্কোর ২২ বছরের আনা বলেন, আমি ঠিক আছি কিন্তু পুরো পরিস্থিতি বেশ জটিল। আমার সব বন্ধু হতভম্ব। আমরা কেউ এই যুদ্ধ চাই না। আমরা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমাদের এই অবস্থান প্রকাশ করার অধিকার আমাদের নেই। বিক্ষোভ করার কারণে ধরপাকড় করে আটকে রাখা বা জরিমানা করা হচ্ছে। আর এখন তো যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য দিলে ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। আমার অনেক বন্ধু এখন দেশ ছেড়ে যাচ্ছে, আমি তাদের অবস্থাটা বুঝতে পারি।

রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ মেটাকে (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ) চরমপন্থী বলে অভিহিত করতে যায়। এসব প্ল্যাটফর্ম রাশিয়ায় আর তাদের কর্মকাণ্ড চালাবে না। কিন্তু আমি মনে করি, ভিপিএনের মাধ্যমে এগুলো ব্যবহার করা যাবে। তবে আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চ্যাট হিস্ট্রি মুছে দিয়েছি। কারণ, গণপরিবহনে পুলিশ তল্লাশি করে মুঠোফোনে কী আছে, তা দেখতে চায়। পুলিশ সম্প্রতি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে। যুদ্ধবিরোধী পোস্টার লাগানোর কারণে তাকে দুই মাসের জন্য গৃহবন্দী করা হয়। যদিও বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। পুরো পরিস্থিতি অবশ্যই ভয়ংকর।
পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো আগের প্রজন্মের লোকজন প্রপাগান্ডায় ডুবে যাচ্ছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, পুতিন যা করছেন, তা ঠিকই আছে। এ এক অনাসৃষ্টি। আমি ইতিমধ্যে আমার বাবা ও দাদার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি।

কিন্তু এখন আমি বেশ আশাবাদী। পুরো বিশ্ব বুঝতে পারছে, রাশিয়ার লোকজন এই যুদ্ধকে পছন্দ করছে না। এই যুদ্ধ একজন প্রেসিডেন্ট শুরু করেছেন, যিনি নিজের বানানো অযৌক্তিক অবাস্তব দুনিয়ায় বাস করেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য যদি কারাদণ্ড না হতো, তাহলে আমার মতো মানুষদের এক করার চেষ্টা করতাম। তাদের সহায়তায় দেশটির শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য আমার পক্ষে যা করা সম্ভব, তার সব করতাম।

মনে হচ্ছে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই

যুদ্ধের কথা মনে হলেও মস্কোর বাসিন্দা ২৫ বছরের ইয়ানা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। মন খারাপ হয়, হতাশ লাগে। তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারি না যে কেউ কীভাবে এই পদক্ষেপ নিতে পারে, অন্যদের হত্যা করতে নিজের দেশের লোকদের যুদ্ধে পাঠাতে পারে, এটা ভয়ংকর।
একদিকে এটি প্রত্যেক মানুষের ওপর মানসিক, অর্থনৈতিকসহ নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে আমি বুঝতে পারি, আমরা যদি এগুলোর পরিবর্তন আনতে কিছু করার চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের আঘাতের মুখোমুখি হতে হবে। এর মানে হলো আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কোনো আরজি, কোনো বিক্ষোভ নিষিদ্ধ। ধরেন, কোনো এলাকায় পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে, সেখান দিয়ে কেউ হাঁটলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব পাস হয়েছে

বর্তমানে আমরা প্রতিদিনই পরিস্থিতি পাল্টাতে দেখছি। এর মধ্যে আমরা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। যেমন যদি ব্যাংক চালু না থাকে, তাহলে বিদেশি পণ্যের দাম আমরা কীভাবে পরিশোধ করব? আবার যেমন রাশিয়ান নাগরিক হওয়ার কারণে যেসব প্রকাশনা, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও সম্মেলন থেকে বাদ পড়ছি, সেগুলোর আমরা কী করব?
যেমন আমরা জুমে ঢুকতে পারি না, বিশেষায়িত অ্যাপগুলো, যেমন ম্যাটল্যাব (প্রোগ্রামিং অ্যান্ড কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম) ও কোর্সেরায় (অনলাইন কোর্স প্ল্যাটফর্ম) ঢুকতে পারি না। সাধারণ জিনিসপত্র, যেমন প্রসাধনসামগ্রী ও খাবারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো কেনা ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। কারণ, এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য আমাদের কোনো কারখানা নেই।

আমার ল্যাবরেটরিতে এক সহকর্মী আছেন, যিনি বিজ্ঞানবিষয়ক প্রকাশনার পর্যালোচনা করেন। তিনি জানান, এখন যারা তাদের লেখা প্রকাশ করতে চায় ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের আবেদন স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এসব আবেদন প্রত্যাহার করা হয়নি। সম্মেলনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। মস্কোতে সব ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে।
এসব বিষয় আমার ওপরও প্রভাব ফেলে। আমি এ মাসেই একটি লেখা প্রকাশ করতে চাইছিলাম। আমরা দেখছি চাল, আটা, চিনি, কৌটাজাত খাবার নাই হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এটি হচ্ছে আতঙ্কে। এর আগে আমি কখনো স্টোরে খালি তাক দেখিনি। গতকাল আমি কন্ট্যাক্ট লেন্স কিনতে গিয়ে পাইনি। কারণ, শেষ। অথচ আগে এটা হরহামেশাই পাওয়া যেত।

এটিএম বুথের সামনেও লম্বা কোনো লাইন নেই। অথচ কিছুদিন আগেও ছিল। এখন তো আমরা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এটিএম থেকে বিদেশি মুদ্রাও তুলতে পারব না। আমি রাশিয়া ছাড়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সেখানে অর্থকড়ি একটি বড় বিষয়। কারণ, টিকিটের দাম ১০ গুণ বেড়েছে। তারপরও কেউ আমার জন্য বসে থাকবে না।
দেখতেই পাচ্ছেন, প্রতিদিনের সমস্যাগুলো থেকে বৈশ্বিক সমস্যাগুলোকে আলাদা করা কঠিন। এই উদ্বেগ ভুলে থাকতে আমরা বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি ও বসন্ত উপভোগ করছি।

আমার মা–বাবা যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারেন, আমি জানি না কেন

মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য চীনের কাছে সামরিক সহায়তা চেয়েছে রাশিয়া

মস্কোর ২৮ বছররের তাতায়ারা বর্তমানে আছেন জার্মানিতে। তিনি বলেন, আমার মা–বাবার কাছে এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা থাকতে পারে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না কেন? আমি শারীরিকভাবে ঠিক আছি। কিন্তু মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। তারপরও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছি। গত বছর আমি মাস্টার্স করতে জার্মানি চলে আসি। কিন্তু আমার পুরো পরিবার এখনো রাশিয়ায়।

আমি এই সময়ে আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করছিলাম কিন্তু এটি আর সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। আমি বলতে চাইছি, সম্ভবত রাশিয়ায় যাওয়ার একটি উপায় আছে কিন্তু আমার পড়াশোনায় ফিরে আসার উপায় প্রায় শূন্য। যেহেতু একটি নতুন সেমিস্টার আসছে, তাই আমি এই ঝুঁকি নিচ্ছি না।

আমার এই মুহূর্তে রেসিডেন্সি পারমিট আছে কিন্তু এটি মে মাসে শেষ হয়ে যাবে। সবকিছু এত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, আমি রাশিয়ান হওয়ার কারণে এটি নবায়ন করতে সমস্যা হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগে আছি।

রাশিয়ান কার্ডগুলো ব্লক হয়ে যেতে পারে এবং আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় আমার পরিবার আমাকে অগ্রিম কিছু অর্থ পাঠিয়েছিল এবং আমাকে দ্রুত তা তুলে নিতে হয়েছিল।

আমার পরিবার ইতিমধ্যে দামের পরিবর্তন দেখেছে। দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় আমার বোন আমার ভাগনের জন্য শিশুপণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। আমার দুলাভাই এবং আমার বাবা তাঁদের চাকরি হারাবেন। কারণ, তাঁরা যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেগুলো ইউরোপের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিল এবং এসব প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগের সব লাইন এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

দক্ষিণ ইউক্রেনে আমাদের এক দূরের আত্মীয় আছেন। তাঁদের শহর সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। এই মুহূর্তে তাঁরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদে থাকলেও তাঁদের নিয়ে আমার পরিবার উদ্বিগ্ন।

আমরা সবাই মানসিকভাবে আক্রান্ত, ভীত এবং চাপে আছি। কয়েক মাস ধরে আমি আমার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লড়ে যাচ্ছি। এখন যা কিছু ঘটছে, তা আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করছে।

আমি যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমার বেশির ভাগ বন্ধু এবং আমার পরিচিতদের মনোভাবও একই। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স আমার কাছাকাছি ও পড়াশোনাও প্রায় একই পর্যায়ের। যাহোক, যখন পরিবারের কথা আসে, দুর্ভাগ্যবশত আমার মা–বাবার সঙ্গে এ নিয়ে আমার ভিন্নমত আছে।

২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলে নেয় রাশিয়া। একটি জরিপ নিয়ে কথা বলছেন পুতিন। জনগণকে বড় স্ক্রিনে তা দেখানো হচ্ছে।

আমি সত্যিই বলতে পারি না, তাঁরা যা বিশ্বাস করেন, কেন তা বিশ্বাস করেন। হতে পারে তাঁদের অতীত সোভিয়েতপ্রীতি বা এত বছর ধরে সরকারের চালানো প্রচার বা তাঁরা যা চিন্তা করেন, তা থেকে বিশ্ব আলাদা—এই মতামতকে মেনে নিতে ভয় ও উদ্বেগ।
যা–ই হোক না কেন, এ নিয়ে আমি কঠিন সময় পার করছি। কখনো কখনো আমি তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করি, যা স্পষ্টতই কাজ করে না। তাঁরা সাধারণভাবে যুদ্ধকে সমর্থন করেন না, তাঁরা যুদ্ধ বন্ধ করতে চান। তবে তাঁরা এই যুদ্ধকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করতেই পারেন।

আমি এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বাঁচতে চাই না

পছন্দের সব ব্র্যান্ডের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিষণ্ন ২০ বছরের কিরা। মস্কোতে থাকেন তিনি। সেখানে এইচঅ্যান্ডএম, বেরশকা ও পিঅ্যান্ডবির মতো ব্র্যান্ডগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তাঁর প্রিয় রাশিয়ান শোরুমগুলো খোলা আছে।

কিরা বলেন, আমি সদ্যই একটি আইফোন কিনেছি। মূল্যস্ফীতির মাত্র তিন দিন আগে। এটি আরও সস্তা ছিল কিন্তু এখন আমি এয়ারপড কিনতে চাই। তবে তা সত্যিই ব্যয়বহুল। এগুলোর দাম ছিল ৭ হাজার রুবল, এখন ১৪ হাজারের বেশি দাম।

আমার বন্ধু একটি আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন প্রকাশকের প্রশিক্ষণার্থী হতে যাচ্ছিল কিন্তু তার প্রথম দিনেই ম্যাগাজিনটি রাশিয়ায় তাদের কাজ বন্ধ করে দেয়। আমি খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত। আমি নিশ্চিত যে আপনি এফআইভিবি বিশ্ব ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২ সম্পর্কে জানেন, যা রাশিয়ায় হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এটা এখন রাশিয়ায় হবে না। এটি আপনার শরীর থেকে পা কেটে ফেলার মতো। এটা জঘন্য। আপনি যার জন্য বেঁচে ছিলেন, তা ছাড়া আপনি কীভাবে বাঁচবেন?

আমি একটি সরকারি ই-মেইল পেয়েছি। সেখানে ১৪ মার্চের মধ্যে ইনস্টাগ্রামের সব ফাইল ডাউনলোড করতে বলা হয়। কারণ, এরপর এটি কাজ করবে না। টিকটক এখনো নেই। আমাদের কাছে ফেসবুকের বিকল্প হিসেবে রাশিয়ান ভিকে আছে কিন্তু এটি ফেসবুকের মতো নয়।

এখন আমি টেলিগ্রাম শব্দটিও খুঁজে পাচ্ছি না, আগে যেখানে ইনস্টাগ্রামে প্রতিটি স্টোরির সঙ্গে টেলিগ্রাম শব্দটি যোগ করা থাকত। ইনস্টাগ্রাম যখন বন্ধ করে দেওয়া হলো, তখন মানুষ নতুন করে টেলিগ্রাম অ্যাপে যুক্ত হচ্ছিলেন। অনেকেই লিখেছিলেন, ‘চলো আমরা পারস্পরিক যোগাযোগ বজায় রাখি’, কেউ লিখেছেন, ‘ইনস্টাগ্রামে এটাই আমার শেষ স্টোরি, টেলিগ্রামে দেখা হবে’।

আমার বেশির ভাগ বন্ধুই বলছে, আমাদের সরকার ভয়ংকর। আমি সেই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করি না, তবে আমি মনে করি, আমাদের কিছু পরিবর্তন দরকার।
এখানে যুদ্ধের বিপক্ষে অনেক র‌্যালি হয়। কিন্তু প্রবীণ প্রজন্ম প্রেসিডেন্টের পক্ষে। আমার এক বন্ধু ও তার দাদার মধ্যে এই মতভিন্নতা নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে। আমাদের প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার অনুভূতি মিশ্র।

ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করেছে রাশিয়া

আমি শান্তি চাই কিন্তু আমার দাদি মনে করেন, পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ানদের রক্ষা করার জন্য আমাদের সামরিক বাহিনী প্রয়োজন। এ ছাড়া আমার প্রতিবেশী পশ্চিম ইউক্রেন থেকে এসেছেন। তিনি আমাদের প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করেন, যদিও তাঁর পুরো পরিবার এখনো সেখানে রয়েছে। যখন আমি ইউক্রেনীয় জনগণের কাছ থেকে এটি শুনি, তখন আমাদের প্রেসিডেন্টের গৃহীত কৌশল ভুল কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। হয়তো পুতিন এবং তাঁর সহযোগীরাই ভালো জানেন। আমি আশা করি, তাঁরা শিগগিরই এটি বন্ধ করবেন।

আমাদের অর্থনীতির অবস্থা আজ ভালো নয়। আমাদের প্রেসিডেন্টের উচিত আমাদের ও তাঁর লোকদের কথা চিন্তা করা। আমার ভবিষ্যতের কী হবে? আমি এখানে বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে চাই না।

আমি সত্যিই বুঝতে পারি না, কেন রাশিয়ানদের ম্যাকডোনাল্ডসে খাওয়ার অধিকার নেই। অবশ্য এটি একটি অদ্ভুত উদাহরণ হতে পারে কিন্তু আমি বলতে চাই, আমরা যারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, আমাদের এর জন্য ভুগতে হচ্ছে।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মৃত্যু অথবা যাবজ্জীবন

অধিকাংশ নিষেধাজ্ঞা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। সরকারপ্রধানেরা এই ভয়াবহতা শুরু করল আর সাধারণ মানুষের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সাধারণ দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া এবং দোকান থেকে কিছু কিছু খাবার সরিয়ে নেওয়া অযৌক্তিক। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কেন এসব কেড়ে নেওয়া? আমরা ইতিমধ্যে গভীর ... মধ্যে আছি। বিশ্ববাসী আমাদের ঘৃণা করে, এটি যথেষ্ট—এই কথাগুলো ২১ বছরের কাতায়ার। মস্কোর বাসিন্দা তিনি।

কাতায়া বলেন, ভবনের সংস্কারকাজগুলো খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে শুরু করায় শিগগিরই আমার নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ঠিকঠাক করার কথা ছিল। কিন্তু এখন সেখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখন আমাকে এমন জায়গায় দীর্ঘকাল থাকতে হবে, যেখানে আমি মোটেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না

আমি বন্ধ করে দেওয়া সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশাধিকার ছাড়াই ঢুকতে পারি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক রাশিয়ান শুধু বিনোদনমূলক বিষয়বস্তু থেকেই যে বঞ্চিত হচ্ছে, তা নয়; বরং তাঁদের স্মৃতি, কর্মকাণ্ড ও যা ঘটছে, সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও সত্য তথ্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন; যা একটি জম্বি বক্স (টেলিভিশন) থেকে পাওয়া যায় না। তারা সেখানে (টিভি) আমাদের সঙ্গে নির্লজ্জভাবে মিথ্যা কথা বলে।

আমি যেখানে আছি, সেখানে লোকেরা সাধারণত সমাবেশে, সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে এবং তাঁদের অভ্যন্তরীণ গণ্ডিতে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন। সাধারণত মানুষ গোপনে প্রতিবাদের কথা ছড়িয়ে দেন। তবে যাঁরা অংশ নিতে চান, তাঁরা সহজেই তা সম্পর্কে জানতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট কিছু অনলাইন গ্রুপে তাঁরা শুধু একটি সংখ্যা পোস্ট করবেন (একটি তারিখ নির্দেশ করে) আর এ থেকে সবাই সবকিছু বুঝে নেন। কিন্তু আমি আমার মনোভাব প্রকাশ করতে নিরাপদ বোধ করি না, বিশেষ করে অনলাইনে বা ফোনে কথা বলার সময়। আমি প্রতিবাদে যোগ দিই না ভয়ে। ধরা পড়লে এর মানে হলো মৃত্যু অথবা যাবজ্জীবন। উপরন্তু আমি দেখেছি, অনেক বছর ধরে বিক্ষোভ করেও লোকজন কিছু অর্জন করতে পারেনি। সরকারের জনগণকে প্রয়োজন নেই।

রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে। অনেকে এ নিয়ে প্রকাশ্যে চিৎকার করে কিন্তু এটা ভালো কিছু দিয়ে শেষ হয় না। আমরা সত্যিই সাহায্য করতে চাই কিন্তু আমরা নিজের দেশেই সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। এখন অন্য দেশে যুদ্ধ বন্ধ করতে চারপাশ থেকে অনুরোধ আসছে। বিশ্বাস করুন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা এটি সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যগুলোতে লিখি, পিটিশনে স্বাক্ষর করি, অর্থ পাঠাই, সমাবেশে যাই কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি কোনো ফল দেয়নি, সরকার শুধু আমাদের আঘাত করে।