তুরস্কের বেরেকতার কোম্পানির তৈরি টিবি২ ড্রোন
তুরস্কের বেরেকতার কোম্পানির তৈরি টিবি২ ড্রোন

রাশিয়াকে রুখতে বড় ভূমিকা রাখছে তুরস্কের ড্রোন

ইউক্রেনে রুশ বাহিনী হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্নভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে মানবিক সহায়তা দেওয়া থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে দেশগুলো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে ইউক্রেনে। উন্নত দেশগুলোর মতো তুরস্কও ইউক্রেনে যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠিয়েছে, এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন ব্যবহার করছে টিবি২ মডেলের তুরস্কের ড্রোন। খবর আল-জাজিরার।

অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে তুরস্কের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করছে ইউক্রেন। বেরাকতার-টিবি২ নামের ড্রোনটি নির্দিষ্ট স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম। কিন্তু প্রায়ই ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের সময়, বাস্তব ঘটনা এবং ভুল তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যায়। যদিও তুরস্কের ড্রোন ব্যবহার করে হামলার কিছু ভিডিও ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখের মিলিটারি টেকনোলজি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষক মাউরো গিলির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আল-জাজিরার। মাউরো গিলি বলেন, যুদ্ধের ফলে চলমান বিশৃঙ্খলার কারণে এটা অনুমান করা খুবই কঠিন যে তুরস্কের দেওয়া ড্রোনগুলো ইউক্রেন কতটা কাজে লাগাতে পারছে।

মাউরো গিলি বলেন, ‘অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজে টিবি২ ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খণ্ডিত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এ কারণে যেকোনো তথ্য গ্রহণ করার আগে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’

মাউরো গিলি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে তুরস্কের কাছ থেকে বেশ কিছু ড্রোন কিনেছিল ইউক্রেন। ওই সময় ইউক্রেনে বসেই ড্রোন উৎপাদনের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, এখন পর্যন্ত ড্রোনের উৎপাদন শুরু হয়নি।’

২০১৯ সাল থেকে তুরস্কের কাছ থেকে বেশ কিছু ড্রোন কেনে ইউক্রেন। এদিকে ২০২০ সালে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে বিরোধপূর্ণ নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে এসব ড্রোন ব্যবহার করেছিল আজারবাইজান।

গিলি আরও বলেন, টিবি২ ড্রোনটি তুরস্কের বেরেকতার কোম্পানি উৎপাদন করে। তুরস্কের ড্রোন উৎপাদনকারী দুটি বিখ্যাত কোম্পানির মধ্যে বেরেকতার অন্যতম। অপরটি হলো টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি উৎপাদিত ড্রোন আঙ্কা। ড্রোনগুলো পশ্চিমা দেশে উৎপাদিত ড্রোনের চেয়ে তুলনামূলক সস্তা। কিন্তু নির্দিষ্ট স্থাপনা, উচ্চতা থেকে সঠিকভাবে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে হামলা চালাতে এটি সক্ষম।

তবে তুরস্কের ড্রোনের কতটুকু সক্ষম, সেটি নির্ভর করছে রুশ বিমানবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর। গিলি বলেন, টিবি২-এর মতো ড্রোন অ্যান্টি-এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে ততটা কার্যকর নয়। এটিকে কার্যকর করতে একটি বুদ্ধিমত্তানির্ভর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। এর সঙ্গে এমন একটি ইলেকট্রনিক সিস্টেম চালু করতে হবে, যেটি সুচারুভাবে শত্রুপক্ষের রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এই প্রযুক্তি ততটা কার্যকর না-ও হতে পারে। কারণ, ইতিপূর্বে লিবিয়া যুদ্ধে তুরস্কের তৈরি ড্রোন ঠেকানোর উপায় বের করেছিল রাশিয়া। একপর্যায়ে ড্রোনগুলো গুলি করে ভূপাতিতও করা হয়েছিল। একই অবস্থা দেখা গিয়েছিল সিরিয়া ও নাগোরনো-কারাবাখে।

কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন। তবে ইউক্রেনে রুশ বাহিনী হামলা চালানোর পর থেকে এরদোয়ানের পক্ষে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে কয়েক শ স্টিংগার ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে ইউক্রেন

লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইরদি ওজতুর্ক বলেন, তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের আগে থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে।

ইরদি ওজতুর্ক আরও বলেন, নব্বইর দশকে ইউক্রেনের স্বাধীনতার সময় দেশটির প্রতি জোরালো সমর্থন ছিল তুরস্কের। স্বাধীনতার পরে দেশ দুটি কৃষ্ণ সাগরে অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং সামরিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় যৌথভাবে কাজ করছে।

এদিকে ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগের মধ্যেও রাশিয়া তার তৎপরতা বন্ধ করতে রাজি নয়। ইরদি ওজতুর্ক আরও বলেন, এমন পরিস্থিতিতে তুরস্ক তাদের ড্রোনের মাধ্যমে ইউক্রেন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি ইউক্রেন ও পার্শ্ববর্তী দেশ মলদোভায় আট ট্রাক মানবিক সহায়তাসামগ্রী পাঠিয়ে ইউক্রেনের প্রতি পুরোনো বন্ধুত্বের নিদর্শন রেখেছে তুরস্ক। অন্যদিকে এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গত রোববার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের ফোনালাপে যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জানান এরদোয়ান।

তবে সামগ্রিক পরিস্থিতিতে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে এরদোয়ান বেশ সতর্ক। এ অবস্থায় তিনি প্রত্যক্ষভাবে কোনো পক্ষকেই সহায়তা করতে পারছেন না। কারণ, এতে নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
ওজতুর্ক বলেন, ইউক্রেনে রুশ হামলার পঞ্চম দিনেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পাশে থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন এরদোয়ান। তিনি আরও বলেন, তুরস্ক এখনো ভারসাম্যভিত্তিক নীতি বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তবে তার অর্থ এই নয় যে তুরস্ক কোনো দ্বিধা ছাড়াই তার নীতিগুলো প্রতিষ্ঠা করছে। অন্যদিকে রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও জ্বালানি ইস্যুতে তুরস্ক একধরনের সিদ্ধান্তহীন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।

তুরস্কের তৈরি ড্রোন ইউক্রেন ব্যবহার করলেও বিষয়টি নিয়ে রাশিয়াকে তেমন একটা উদ্বিগ্ন দেখা যায়নি। যেমনটা বলছিলেন লন্ডনের লবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল গভর্ন্যান্স বিভাগের প্রভাষক ক্রিশ্চিয়ান নিতোই। তিনি বলেন, ড্রোন ব্যবহারের পরও রাশিয়া-তুরস্কের মধ্যে সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরেনি।
ক্রিশ্চিয়ান নিতোই আরও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, ইউক্রেনে তুরস্কের সামরিক সহায়তা নিয়ে এরদোয়ান এবং পুতিনের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।’ আলোচনায় ড্রোনের বিষয়টিও স্থান পেয়েছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।