যে কারণে ফিনল্যান্ড–সুইডেনকে ন্যাটোতে দেখতে চায় না তুরস্ক

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর নিরাপত্তা শঙ্কা থেকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটো জোটের অনেক সদস্যদেশ ইতিমধ্যে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে তুরস্ক সরকার বলেছে, ফিনল্যান্ড–সুইডেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় তাদের আপত্তি রয়েছে। এ উদ্যোগে বাধা দেবে আঙ্কারা।

এমনকি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলেনে বলেছেন, তুরস্ককে রাজি করাতে নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আঙ্কারা পাঠানোর কথা জানিয়েছে ফিনল্যান্ড–সুইডেন। এর প্রয়োজন নেই। তাঁদের সফরের ফলে দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন করবে না তুরস্ক।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, তুরস্কসহ ৩০টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। জোটের নিয়ম অনুযায়ী, নতুন সদস্য যুক্ত করতে হলে সব সদস্যদেশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। তাই বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাজি থাকলেও তুরস্কের বাধার কারণে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।
গত শুক্রবার ইস্তাম্বুলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, ‘পুরো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অতিথিশালা। এ পরিস্থিতিতে আমরা তাদের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা সমর্থন করতে পারি না।’

ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়া রাশিয়ার জন্য নিরাপত্তাজনিত হুমকি বয়ে আনবে না। তবে পশ্চিমারা আমাদের প্রতিবেশী দেশে অস্ত্র ও সেনা মোতায়েন করলে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ভ্লাদিমির পুতিন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট

এরপর সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে তিনি আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টায় বাধা দেবে আঙ্কারা। এ সময় ফিনল্যান্ড–সুইডেনের উদ্দেশে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তারা (ফিনল্যান্ড ও সুইডেন) অবস্থান সুস্পষ্ট না করা পর্যন্ত আমরা কীভাবে এ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে পারি?’

এ সময় গ্রিসের প্রসঙ্গ টেনে এরদোয়ান বলেন, ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে গ্রিসের সদস্যপদ সমর্থন করে তুরস্ক বড় ভুল করেছিল। একই ভুল আর করতে চান না তাঁরা। উল্লেখ্য, তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে বৈরিতা অনেক পুরোনো। ন্যাটোর সদস্য হয়েও দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়েছে।

ফিনল্যান্ড–সুইডেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। তিনি বলেছেন, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়া রাশিয়ার জন্য নিরাপত্তাজনিত হুমকি বয়ে আনবে না। তবে পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করে পুতিন বলেন, প্রতিবেশী দেশে অস্ত্র ও সেনা মোতায়েন করলে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে। এর আগেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ন্যাটোতে যোগ দিলে ফিনল্যান্ড বড় ‘ভুল করবে’।

রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। তবে ৫৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে নিয়োগপ্রাপ্ত সেনার সংখ্যা মাত্র ১৩ হাজার। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দুটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশটির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চলা এসব লড়াইয়ে ফিনল্যান্ড অনেক ভূমি হারিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা ভোলেনি দেশটির মানুষ। তাই সোভিয়েত উত্তরসূরি রাশিয়া তাদের দেশে হামলা চালাতে পারে, এ আশঙ্কায় ভুগছে ফিনল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষ। এ জন্য ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে সম্মতি রয়েছে তাদের।

ফিনল্যান্ড–সুইডেনের চাওয়া, তাদের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিষয়টিকে দর–কষাকষির মাধ্যম না করুক আঙ্কারা। তাই দেশ দুটি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের তুরস্কে পাঠাতে চাইছে।

একই আশঙ্কা থেকে সুইডেনও ন্যাটোয় যুক্ত হতে চায়। গত সোমবার রাজধানী স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসন। তিনি বলেন, তাঁর দেশ ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার আবেদন করবে। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এক যুগ থেকে আরেকটি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।’

এর আগে রোববার ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো সাংবাদিকদের বলেন, আজ প্রেসিডেন্ট এবং সরকারের বৈদেশিক নীতি কমিটি যৌথভাবে পার্লামেন্টে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিনল্যান্ড ন্যাটো সদস্যপদের জন্য আবেদন করবে। এটা এক ঐতিহাসিক দিন, নতুন যুগের সূচনা।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এর তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে ফিনল্যান্ড–সুইডেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশ দুটির আগের অবস্থানের একেবারেই বিপরীতমুখী। কারণ, ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে ফিনল্যান্ড সামরিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার নীতিতে অটল ছিল। সুইডেনও দুই শতকের বেশি সময় ধরে সামরিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার নীতি মেনে চলেছে। এখন দীর্ঘদিনের নীতি বদলে দেশ দুটি পশ্চিমা সামরিক জোটে যুক্ত হচ্ছে মূলত রাশিয়ার চোখ রাঙানির ভয়ে।

কিন্তু তুরস্কের আপত্তির কারণ কী? শুধু রাশিয়া ও দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, নাকি অন্য কিছু? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক পল অ্যাডামস বলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কিছুটা পেছনে তাকাতে হবে। এমনকি এরদোয়ানের বক্তব্যেও এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের বিরুদ্ধে তুরস্কের অভিযোগ, দেশ দুটি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) প্রতি সহানুভূতিশীল। এই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেয় তারা। পিকেকেকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে আঙ্কারা। সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিল সুইডেন। এ কারণে গত বছরের এপ্রিলে আঙ্কারায় সুইডিশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। সুইডেনের পার্লামেন্টে এখন ছয়জন এমপি রয়েছেন, যাঁরা জাতিগত কুর্দি। তাঁরা কুর্দি ইস্যুতে সোচ্চার। তাই এরদোয়ান তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলকে সন্ত্রাসী সংগঠনের অতিথিশালা বলেছেন বলে মনে করছেন পল অ্যাডামস।

পল অ্যাডামসের মতে, ফেতুল্লা গুলেনের অনুসারীদের প্রতি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সমর্থন আঙ্কারার ক্ষোভের বড় একটি কারণ। ২০১৬ সালে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ঘটা অভ্যুত্থানচেষ্টার পেছনে গুলেনের সক্রিয় ভূমিকা ছিল বলে মনে করে তুরস্ক সরকার। এ ছাড়া ২০১৯ সালে সিরিয়ায় হামলার অভিযোগ এনে তুরস্কের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। এ ঘটনাও ভুলতে পারেননি এরদোয়ান।

এ পরিস্থিতিতে ফিনল্যান্ড–সুইডেনের চাওয়া, তাদের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিষয়টিকে দর–কষাকষির মাধ্যম না করুক আঙ্কারা। তাই দেশ দুটি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের তুরস্কে পাঠাতে চাইছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ফিনল্যান্ড–সুইডেনের ন্যাটোর সদস্য হতে বাধা দূর হবে বলে তিনি আশা করছেন।

বিবিসি অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।