রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর নিজের তৈরি এক ‘বদ্ধ’ জগতে আটকা পড়েছেন বলে ধারণা পশ্চিমা গোয়েন্দাদের। আর এ বিষয় নিয়েই তাঁরা উদ্বিগ্ন।
পুতিনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আরও ভালোভাবে বুঝতে বছরের পর বছর ধরে তাঁর মনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে আসছেন পশ্চিমা গোয়েন্দারা। এখন তাঁর মন বোঝা আরও বেশি জরুরি। আজ রোববার বিবিসি অনলাইনের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন পুতিন। ২১ মার্চ এই অভিযান ২৬তম দিনে গড়িয়েছে।
ইউক্রেনে রুশ সেনারা অনেকটা ‘আটকে’ আছেন বলে মনে হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রগতি মস্কোর পরিকল্পনামতো এগোচ্ছে না বলে দাবি পশ্চিমা গোয়েন্দাদের। আর এ কারণেই এখন পুতিনের মন বোঝার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কেননা, চাপের মধ্যে পুতিন ঠিক কী করেন, তা বোঝা দরকার। সে জন্যই পশ্চিমা গোয়েন্দারা তাঁর মন বোঝার চেষ্টা করছেন।
পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ভাষ্য, চলমান সংকট যাতে আরও বিপজ্জনক দিকে মোড় না নেয়, যুদ্ধ যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য পুতিনের মনের অবস্থা বোঝা অত্যাবশ্যক।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রকৃতপক্ষেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তিনি এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন যে তাঁর কাছে কোনো বিষয়ে বিকল্প মতামত পৌঁছানোর পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।
পুতিন যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, তার প্রমাণ হিসেবে সাম্প্রতিক কিছু বৈঠকের দৃশ্য সামনে আনা হচ্ছে। যেমন-পুতিনের সঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর বৈঠক। একটি লম্বা টেবিলের দুই প্রান্তে বসে এই দুই নেতা বৈঠক করেন। অবস্থানগত দূরত্বই তাঁদের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেয়। আবার ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাক্কালে জাতীয় নিরাপত্তা দলের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকও একই বিষয় ইঙ্গিত দেয়।
এক পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, পুতিনের প্রাথমিক সামরিক পরিকল্পনাটি দেখলে মনে হয়, তা হয়তো কেজিবির কোনো কর্মকর্তা তৈরি করছেন। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে পরিকল্পনাটি তৈরি করা হয়েছে। আর এই পরিকল্পনার ফলাফলও হয়েছে বিশৃঙ্খল।
রাশিয়ার সামরিক কমান্ডাররা ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বলে মনে হয়। এমনকি কিছু রুশ সেনা সীমান্তে গেছেন কোনো কিছু না জেনেই।
পুতিনের কাছের বলে পরিচিত অনেক ব্যক্তির চেয়ে পশ্চিমা গোয়েন্দারা ইউক্রেন হামলার পরিকল্পনাটি সম্পর্কে বেশি জানতেন। তবে পশ্চিমা গোয়েন্দারা এখন এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। এই চ্যালেঞ্জটি হলো, পুতিন পরবর্তী সময়ে ঠিক কী করবেন, তা বোঝা। আর কাজটি মোটেই সহজ নয়।
এখন পুতিনকে বোঝা কেন সহজ নয়, তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন জন সিফার। তিনি একসময় মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) ‘রাশিয়া অপারেশন’ পরিচালনার দায়িত্ব ছিলেন। তাঁর মতে, ক্রেমলিনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চ্যালেঞ্জের দিকটি হলো, মস্কোতে পুতিনই এখন একক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তি। যদিও পুতিনের মতামত প্রায়ই প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয় কিন্তু তিনি ঠিক কীভাবে কাজ করবেন, তা বোঝা গোয়েন্দাদের জন্য কঠিন।
যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এম ১৬-এর সাবেক প্রধান স্যার জন সাওয়ারস বলেন, রুশ নেতার মাথায় কী ঘুরপাক খাচ্ছে, তিনি কী ভাবছেন, সে সম্পর্কে ভালো করে বোঝা কঠিন, বিশেষ করে, যখন তাঁর নিজের অনেক লোকই এ বিষয়ে কিছু জানে না।
পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, পুতিন তাঁর নিজের তৈরি করা একটি ছোট বুদ্বুদের মধ্যে আটকে গেছেন। এই বিচ্ছিন্ন, সুরক্ষিত বুদ্বুদে বাইরের তথ্য খুব কমই প্রবেশ করে। বিশেষ করে, সেই সব তথ্য, যা পুতিনের চিন্তাভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান ফার্নহ্যাম বলেন, পুতিন তাঁর নিজের প্রচারণার শিকার। সেটা এই অর্থে যে তিনি শুধু একটি নির্দিষ্টসংখ্যক লোকের কথা শোনেন। বাকি সব কথা তাঁর কাছে যাওয়ার পথ তিনি বন্ধ করে রেখেছেন। তাঁর কাছে যেসব তথ্য যায়, তা তাঁকে বিশ্ব সম্পর্কে একটি অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গির ধারণা দেয়।
প্রকাশিতব্য ‘দ্য সাইকোলজি অব স্পাইজ অ্যান্ড স্পাইং’ বইয়ের সহলেখক অ্যাড্রিয়ান বলেন, একে গোষ্ঠীগত চিন্তা (গ্রুপ থিঙ্ক) বলা হয়। এখানে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তি পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গিকেই শক্তিশালী করেন। আর যদি পুতিন গোষ্ঠীগত চিন্তার শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে জানা দরকার, এই দলটিতে কে বা কারা আছেন।
পুতিন যাঁদের সঙ্গে কথা বলেন, সেই দলের পরিসর কখনোই বড় ছিল না। কিন্তু তিনি যখন ইউক্রেনে হামলার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জানার বিষয় হয়ে ওঠে। পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, এই দলে সেসব লোকই আছেন, যাঁরা কেবল পুতিনের মন-মানসিকতা ধারণ করেন।
পুতিনকে যাঁরা পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা বলছেন, রুশ নেতা গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হচ্ছেন। পুতিনের বিশ্বাস, পশ্চিমারা রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখতে চায়। তাঁকে ক্ষমতা থেকে তাড়াতে পশ্চিমারা বদ্ধপরিকর।
সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নসকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মানসিক অবস্থার মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল। তিনি পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গিকে কঠিন বলে বর্ণনা করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, পুতিন যে দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন, তাঁর সঙ্গে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির দূরত্ব অনেক বেশি।
সিআইএর একটি দল রয়েছে, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিদেশি নেতাদের ‘নেতৃত্ব বিশ্লেষণ’ করে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাঁরা পুতিনকেও বিশ্লেষণ করছে।
২০১৪ সালে তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাকে বলেছিলেন, পুতিন অন্য এক জগতে বাস করেন।
মাখোঁ ও পুতিন যখন বৈঠকে বসেন, তখন বলা হয়েছিল, রুশ নেতা আরও কঠোর আরও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন।
মার্কিন সরকারের সাবেক চিকিৎসক ও কূটনীতিক কেন ডেকলেভার ভাষ্য, পুতিন সম্ভবত মানসিকভাবে অসুস্থ নন। তিনি পরিবর্তিতও হননি। তিনি খুব তাড়াহুড়ো করছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি সম্ভবত আরও বিচ্ছিন্ন হয়েছেন।
পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ভাষ্য, এখন উদ্বেগের বিষয় হলো, নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনো পুতিনের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ইউক্রেন আক্রমণের আগে তাঁর গোয়েন্দারা তাঁকে এমন কিছু বলতে অনিচ্ছুক ছিলেন, যা তিনি শুনতে চান না।
চলতি সপ্তাহে একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেছেন, পুতিন সম্ভবত এখনো জানেন না যে ইউক্রেনে তাঁর দেশের সেনাদের জন্য পরিস্থিতি কতটা খারাপ যাচ্ছে। ফলে রাশিয়ার জন্য আরও বাজে পরিস্থিতি সামনে এলে পুতিন তখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, তা নিয়ে উদ্বেগে আছেন পশ্চিমা গোয়েন্দারা।
বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে