যেসব কৌশলে যুদ্ধ এড়াতে পারেন বাইডেন-পুতিন

ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধলে তা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে
 প্রতীকী ছবি: এএফপি

যখন দুই দেশের মধ্যে কোনো সংকট দেখা দেয়, যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন পর্দার সামনে-পেছনে নানা ধরনের কার্যক্রম চলতে থাকে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আমরা এখন এমনই নানাবিধ কর্মকাণ্ড দেখছি। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের অভিযোগ, যেকোনো সময় হামলা করে ইউক্রেন দখলে নিতে পারেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আর এ জন্য সীমান্তে লাখো সেনা মোতায়েন করেছেন তিনি। তবে রাশিয়া এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, সেনা মোতায়েন মহড়ার জন্য। হামলা চালিয়ে ইউক্রেন দখলের ইচ্ছা মস্কোর নেই।


বসে নেই পশ্চিমারাও। রাশিয়াকে জবাব দিতে ইউক্রেনের পাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ‘সহযোগী সদস্য’ ইউক্রেনকে সহায়তা করতে পোল্যান্ড ও বেলারুশে সেনা মোতায়েন করেছে। সব মিলিয়ে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতিতে এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। যেকোনো সময় একটি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে ইউক্রেনবাসী। সেই সঙ্গে চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি কথার লড়াই, হুমকি-ধমকি।

এ সবই পর্দার সামনের ঘটনা। সেনা মোতায়েন, হুমকি-ধমকির মধ্য দিয়ে মাঠ গরম রাখতে চাইছে উভয় পক্ষ । তবে একটি যুদ্ধ হাজারো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-মানবিক সংকটের জন্ম দেয়, এটা ওয়াশিংটন-কিয়েভ-মস্কো—সবাই জানে, জানে ইউরোপীয় দেশগুলোও। ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধলে হাজারো শরণার্থী পশ্চিম ইউরোপের তুলনামূলক উন্নত দেশগুলোয় পাড়ি জমাবে। করোনা মহামারি চলাকালে ভঙ্গুর অর্থনীতির ইউরোপ এ চাপ সামলাতে পারবে না। তাই মুখে যেটাই বলুক না কেন, ইউরোপীয় নেতারা এখন যুদ্ধ চাইবেন না।

তাই তো পর্দার সামনে-পেছনে চলছে কূটনৈতিক উপায়ে সংকট সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা। এ জন্য মস্কো-কিয়েভে হাজির হয়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ছুটেছেন হোয়াইট হাউসে। বার্লিনে বসেছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার বৈঠক। ইউক্রেনবাসীও যুদ্ধ চায় না। গতকাল শনিবার দেশটির হাজারো মানুষ কিয়েভের রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘যুদ্ধ একমাত্র সমাধান নয়’।

সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে একই দিন ফোনে কথা বলেন পুতিন ও জো বাইডেন। দুই বিশ্বনেতার ফোনালাপেও কূটনৈতিক পদক্ষেপ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যের কথা জানা যায়। পুতিনকে সতর্ক করে দিয়ে বাইডেন বলেন, হামলা হলে ইউক্রেনে চরম মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে। তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, যুদ্ধাবস্থা এড়াতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সামনে আলোচনা ছাড়া গতি নেই, এমনটাই ভাবছেন অনেকে।

ইউক্রেনে সম্ভাব্য রুশ সামরিক আগ্রাসন নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ১২ ফেব্রুয়ারি, ওয়াশিংটনে

ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি বিবিসিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘ইউক্রেন টেনশনস ক্যান ডিপ্লোমেসি প্রিভেন্ট ওয়ার (কূটনীতির মাধ্যমে যুদ্ধ এড়ানো)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটির কূটনৈতিক প্রতিবেদক জেমস ল্যানদালে শান্তিপূর্ণ উপায়ে চলমান সংকট সমাধানের পাঁচটি উপায় চিহ্নিত করেন।

পুতিনের ওপর চাপ প্রয়োগ

সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে পুতিনকে পশ্চিমা দেশগুলো চাপ দিতে পারে। চাপের মুখে পুতিন এমন উদ্যোগ নিলে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে। চাপ প্রয়োগের কৌশল হতে পারে কূটনৈতিক আলোচনা, নানাবিধ সংকটের ভয় দেখানো, কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি।

সবশেষ ফোনালাপে বাইডেন সেই পথে হেঁটেছেন। তিনি পুতিনকে বলেছেন, ইউক্রেনে হামলা করলে আন্তর্জাতিক মহলে পুতিন ও রাশিয়ার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এ ছাড়া পুতিনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ইউরোপীয় মিত্রদের আরও কাছে টানতে ওয়াশিংটনকে কার্যত সহায়তা করেছে। নিরাপত্তাহীনতা থেকে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশ ন্যাটোতে যুক্ত হতে চাইছে। এমনকি রাতারাতি ইউক্রেন এ সামরিক জোটের সহযোগী থেকে সদস্য রাষ্ট্র হয়ে গেলে কেউ অবাক হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ইউরোপীয় মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছিল। ইউক্রেন সংকট তাদের কাছে টানতে বাইডেনের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে। নিশ্চয়ই পুতিন এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সই হওয়া মিনস্ক চুক্তিকে চলমান সংকট সমাধানের অন্যতম উপায় বিবেচনা করছেন অনেকেই। চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করা গেলে সম্ভাব্য যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে ইউক্রেন। তাই তো গত সপ্তাহে মস্কো সফরে গিয়ে পুতিনকে মিনস্ক চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ।

নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তিতে সম্মত হতে পারে মস্কো ও ন্যাটো

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ঘরের পাশের পুঁচকে ইউক্রেনের মাখামাখি পুতিনের পছন্দ নয়। অন্যদিকে ন্যাটোর ভাষ্য, নিরাপত্তাহীনতা বোধ করলে সমমনা যেকোনো দেশ এ জোটের ছাতার নিচে আসতে পারে, তাতে বাধা নেই, ন্যাটো তার পাশে থাকবে। এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ এড়াতে মস্কো ও ন্যাটো একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে। এর ফলে একদিকে ইউক্রেন ন্যাটোর পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়া থেকে বিরত থাকবে। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিমারা সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেবে। বিনিময়ে ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে রাশিয়া। এমন সমঝোতায় লাভবান হবে দুপক্ষই। তবে এ জন্য কূটনৈতিক আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখা জরুরি।

মিনস্ক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা

২০১৪ সালের মার্চে রাশিয়া ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। এরপর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে ধারাবাহিক আলোচনা চালায় ইউক্রেন, সই হয় মিনস্ক চুক্তি। এ চুক্তিকে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে মস্কো-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লড়াই থামানোর রাজনৈতিক কৌশল বলা হয়, তবে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়নি। এই লড়াইয়ে অন্তত ১৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারান।

এখন রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের মুখে মিনস্ক চুক্তিকে সমাধানের অন্যতম উপায় বিবেচনা করছেন অনেকেই। চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করা গেলে সম্ভাব্য যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে ইউক্রেন। তাই তো গত সপ্তাহে মস্কো সফরে গিয়ে পুতিনকে মিনস্ক চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ।

নিরপেক্ষ থাকবে ইউক্রেন

গত শতকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড নিরপেক্ষ থাকার নীতি গ্রহণ করেছিল। সেই মডেল গ্রহণ করতে পারে ইউক্রেন। সাবেক সোভিয়েতভুক্ত হলেও ইউক্রেন অনেক আগেই রাশিয়ার কাছ থেকে সরে এসেছে। ন্যাটোর ‘খোলা দরজা’ নীতি সামরিক জোটটির প্রতি ইউক্রেনের মোহ বাড়িয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যাটোর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখলে মস্কো খুশি হবে। নিরপেক্ষতার মডেল দেশটিকে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাবে। ইতিমধ্যে ফরাসি সরকার নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণের জন্য কিয়েভের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা

এমন একটা চিত্র কল্পনা করুন, যেখানে পুতিন ধীরে ধীরে সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিলেন। অন্যদিকে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে সৈন্য কমিয়ে আনল। ইউক্রেন নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করল। এমন পরিস্থিতি সব পক্ষের জন্যই লাভজনক বিবেচিত হবে। আর এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের আশঙ্কা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তবে এ কৌশল কার্যত অসম্ভব বলেই মনে হয়। কেননা, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট হয়েছে যে নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে এমন কাজ করা সবাই সন্দেহের চোখে দেখবে।

মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারুন ইলমাজ ৯ ফেব্রুয়ারি আল–জাজিরায় লেখা এক নিবন্ধে বলেন, এই মুহূর্তে যুদ্ধে জড়ানো রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুপক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাইডেন মাত্রই আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছেন। তাই এখন নতুন একটি যুদ্ধে জড়ানো তাঁর ভাবমূর্তি খারাপ করতে পারে। ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধলে করোনাকালে রুশ অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে।

ইউরোপকে শরণার্থী সংকট সামলাতে নতুন করে ভাবতে হবে। তাই সব দিক বিবেচনায় ইউক্রেন সংকট সমাধানের অন্যতম কার্যকর কৌশল কূটনীতি। তবে বাইডেন ও পুতিন কিছুদিন যুদ্ধ নিয়ে পাল্টাপাল্টি হুমকি–ধমকি চালিয়ে যেতে পারেন।

কথায় আছে, যুদ্ধে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়, সব কৌশলের খেলা। ইউক্রেনের এখনকার উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে যুদ্ধ এড়াতে চাইলে খোলা মনে ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। দুপক্ষের সেনা সমাবেশ, পাল্টাপাল্টি হুমকি–ধমকির বিপরীতে যেসব কূটনৈতিক উদ্যোগ চলমান রয়েছে, সেগুলো দ্রুত ও কার্যকর উপায়ে এগিয়ে নিতে হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি রয়েছে ‘করে ফেলার আগে সবকিছুই অসম্ভব মনে হয়’। তাই অসম্ভবকে সম্ভব করতে উদ্যোগী হয়ে কাউকে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে এগিয়ে আসতে হবে। সেটা হোক যুক্তরাষ্ট্র, হোক রাশিয়া কিংবা ইউক্রেন। হোক সেটা পর্দার আড়ালে কিংবা প্রকাশ্যে, তাহলেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। বিশ্বে নতুন আরেকটি মানবিক সংকট ঠেকানো যাবে।


তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল–জাজিরা