রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আফ্রিকা মহাদেশ যেহেতু ভৌগোলিকভাবে দূরে অবস্থান করছে, তাই এই যুদ্ধের উত্তাপ তাদের গায়ে লাগবে না, আপাতদৃষ্টে এমন মনে হতে পারে। যদিও বাস্তব চিত্র ঠিক এর উল্টো। দূরে থেকেও রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক কাছেই আছে আফ্রিকার দেশগুলো।
‘কালো কালো মানুষের দেশ’ আফ্রিকা দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু তাদেরও কিছু বলার আছে। ইতিমধ্যে তারা তাদের মতামত স্পষ্ট করেই দিয়েছে, কোনো ভান করেনি।
বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটির চিত্রটা বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রস্তাবটি ছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের নিন্দা ও অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে। প্রস্তাবটি পাস হয়েছে বটে, তবে পাঁচটি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। আর ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বিপক্ষে ভোট দেওয়া পাঁচটি দেশের একটি আফ্রিকার নতুন দেশ ইরিত্রিয়া, যারা ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। আর ভোটদানে বিরত থেকে রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করা দেশগুলোর বড় অংশটিই আফ্রিকার দেশ। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, তানজানিয়া, উগান্ডা, সেনেগাল, মোজাম্বিক, মালি, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মাদাগাস্কার, নামিবিয়া, কঙ্গোসহ ১৭টি দেশ।
অপর দিকে আফ্রিকার বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে মিসর, সুদান, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া, ঘানা, গ্যাবন, জিবুতি, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে, অর্থাৎ রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক–চতুর্থাংশের বেশি সদস্য আফ্রিকার।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ বিষয়ক প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ পড়ে মনে হয়েছে, রাশিয়ার পক্ষ না নিতে আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের ওপর পশ্চিমাদের বেজায় চাপ ছিল। তা না হলে ভোটদানে বিরত থাকা দেশের সংখ্যা আরও বেশি হতো। আবার কয়েকটি দেশকে চাপ দিয়েও টলানো যায়নি। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রী লিন্ডি জুলু, যিনি মস্কোতে লেখাপড়া করেছেন, নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘রাশিয়া সব সময়ই আমাদের বন্ধু। আমরা আমাদের এই সম্পর্ককে খাটো করতে পারি না।’
অপর দিকে সুদানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা অভিযানের দিনই উড়ে যান মস্কোয়, পুতিনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।
আবার নাইজেরিয়া, ঘানার মতো কিছু দেশ স্বাধীন, সার্বভৌম ইউক্রেনে অভিযান পরিচালনা করায় রাশিয়ার সরাসরি সমালোচনা করেছে।
মস্কোর ‘হাইয়ার স্কুল অব ইকোনমিকস’ থেকে প্রকাশিত ২০২১ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এর আগে যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব জাতিসংঘে উঠেছে, আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশই ভোটদানে বিরত থেকেছে। রুশদের বিপক্ষে আফ্রিকা সাধারণত যেতে চায় না।
যদিও আফ্রিকার দেশগুলোর প্রধান জোট আফ্রিকান ইউনিয়ন তাদের সংবিধানের পাতা উল্টিয়ে বলেছে, প্রতিটি দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বে তারা বিশ্বাস করে। তাই রাশিয়ার অভিযান নিন্দনীয় এবং শান্তির স্বার্থে অবিলম্বে দুই পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে হবে।
এভাবে কখনো অস্ত্র দিয়ে, কখনো কূটনৈতিকভাবে একটু একটু করে আফ্রিকায় শিকড় গাড়তে থাকেন পুতিন। এই সম্পর্কের বসন্তে কোকিল ডাক দিয়ে যায় ২০১৯ সালে।
এ লেখায় ১০০ কোটি মানুষের মহাদেশ আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে।
২.
২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়ে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া। বৈশ্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে পুতিন নতুন বন্ধু খুঁজতে তৎপর হন। কারণ, রাশিয়ার অস্ত্রের বড় বাজার দরকার হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে গমসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যেরও নতুন বাজার খোঁজার প্রয়োজন হয়।
তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে কেবল ২০১৪ সালেই আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়ার মৈত্রী হয়েছে। এ সম্পর্ক ঐতিহাসিক। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার মহাদেশের সঙ্গে তাদের হৃদ্যতা। পুতিন কেবল সেই সম্পর্কের ক্যানভাসে কিছুটা তুলির আঁচড় টেনে দিয়েছেন।
আফ্রিকার কিছু দেশ যেমন লিবিয়া, সুদান, মোজাম্বিক, মালি, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। কোথাও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ক্রিয়াকলাপ, কোথাও ইসলামপন্থীদের চোখরাঙানি। পুতিন এসব দেশের নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে পশ্চিমারা এ সমস্যা মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছে। এবার তাঁর দেশ এসব দেশের পাশে থেকে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে দেখতে চায়। পরে রাশিয়া থেকে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ সৈন্যরা এসে এসব দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়। সবার আগে রুশ ভাড়াটে সৈন্য গ্রহণ করে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক নামের দেশটি, ২০১৭ সালে। এরপর আরও অনেক দেশ ওই পথ গ্রহণ করে। ২০২০ সালের শেষের দিকে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে এক সশস্ত্র বিদ্রোহ দমন করে প্রশংসিত হয় রুশ সৈন্যরা।
আফ্রিকার দেশগুলো যত অস্ত্র আমদানি করে, এর অর্ধেক আসে রাশিয়া থেকে। অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা খনিজ তেলসমৃদ্ধ আলজেরিয়া আর মিসর।
প্রসঙ্গত, রুশ কোম্পানি ওয়াগনার গ্রুপ, যেটি গঠিত রুশ সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের দিয়ে, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে নিরাপত্তা সহায়তা দিচ্ছে। পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েভগেনি প্রিগোজিন এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছেন। অবশ্য ওয়াগনার গ্রুপের ওপর অবরোধ দিয়ে রেখেছে পশ্চিমারা।
পশ্চিমাদের অভিযোগ ছিল, রাশিয়া আফ্রিকার সেনা মদদপুষ্ট, অজনপ্রিয়, জনবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের ক্ষমতায় রাখতে কাজ করছে। অর্থাৎ রুশ সেনারা কাজ করছে ক্ষমতাসীন এলিটদের পক্ষে। আর এ কাজ করতে গিয়ে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে চরমভাবে। রাশিয়া অবশ্য কখনোই তা স্বীকার করেনি।
এভাবে কখনো অস্ত্র দিয়ে, কখনো কূটনৈতিকভাবে একটু একটু করে আফ্রিকায় শিকড় গাড়তে থাকেন পুতিন। এই সম্পর্কের বসন্তে কোকিল ডাক দিয়ে যায় ২০১৯ সালে। ওই বছর রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সোচিতে আফ্রিকার দেশগুলোর এক সম্মেলন হয়, যেখানে ৫০টিরও বেশি দেশ অংশ নেয়। এর মধ্যে ৪৩ জনই ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান। ভ্লাদিমির পুতিন ওই সম্মেলনে বক্তব্য দেন। যেকোনো প্রয়োজনে আফ্রিকার পাশে থেকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির অঙ্গীকার করেন তিনি।
পরবর্তী বছরগুলোতে বিনিয়োগ তেমন না বাড়লেও আফ্রিকায় বাণিজ্য বাড়ে রাশিয়ার। আফ্রিকার দেশগুলো যত অস্ত্র আমদানি করে, এর অর্ধেক আসে রাশিয়া থেকে। অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা খনিজ তেলসমৃদ্ধ আলজেরিয়া আর মিসর। এ ছাড়া নাইজেরিয়া, তানজানিয়া ও ক্যামেরুনেও রুশ অস্ত্রের বাজার বাড়ছে।
একটি তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। চীনও অনেক বছর ধরে আফ্রিকায় কাজ করছে। বড় বিনিয়োগ নিয়ে হাজির হয়েছে তারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোর উন্নয়নকাজ চলছে। বিনিময়ে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদের অনুসন্ধানে কাজ করছে চীনা কোম্পানি।
একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে চীন আফ্রিকার যেসব দেশে কাজ করছে, সেখানে তারা সাধারণ মানুষের জীবিকার উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে। আর রাশিয়ার কাজে উপকৃত হচ্ছেন কেবল রাষ্ট্রনায়কেরা। সাধারণ মানুষ খুব কমই লাভবান হচ্ছে।
৩.
এবার আফ্রিকার দিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি মূল্যায়ন করা যাক। শত শত বছর ধরে ঔপনিবেশিক শাসন আফ্রিকাকে নিঃস্ব করেছে, রিক্ত করেছে। ফরাসি, ব্রিটিশ, ইতালীয়, পর্তুগিজ উপনিবেশবাদীরা বিদেয় হয়েছে, কিন্তু এখনো রয়ে গেছে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি, চোখরাঙানি।
যেমন মালি। সাবেক ফরাসি এই কলোনিতে এখনো ফরাসি সৈন্যরা রয়েছেন। দেশটিতে রয়েছে ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা। অতি সম্প্রতি মালির শাসক সেখানে রাশিয়ার ওয়াগনার কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ নিয়ে চরম অস্থিরতার মধ্যে আছে দেশটি। দেশটির একজন পর্যবেক্ষকের কথায়, ইউক্রেনের যে অবস্থা তার চেয়ে খুব ভালো অবস্থায় নেই মালি।
এসব পরিস্থিতিতে আফ্রিকাকেও অনেক কায়দা কৌশল বের করতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকার নেতারা পূর্ব, পশ্চিম সব দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক জোরদারে প্রাধান্য দিচ্ছেন। যাতে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সহায়তা প্রাপ্তিতে বৈচিত্র্য আসে এবং বিকল্প থাকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে এখন আফ্রিকার প্রতি একধরনের মনোযোগ বেড়েছে। ইইউ চাচ্ছে, রাশিয়ার ওপর থেকে গ্যাসের নির্ভরতা কমাতে। এ সুযোগ নিতে চাচ্ছে আফ্রিকা। তানজানিয়া একটি গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ। গ্যাস রিজার্ভের দিক থেকে আফ্রিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে তারা। দেশটির প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান সম্প্রতি বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট পরিস্থিতিতে তাঁর দেশের গ্যাসসম্পদের প্রতি ইইউর আগ্রহ বেড়েছে। অপর দিকে নাইজেরিয়া অনেক বছর ধরেই ইউরোপের কয়েকটি দেশে এলএনজি রপ্তানি করছে। এবার এ তালিকায় যোগ হতে যাচ্ছে নাইজার ও আলজেরিয়া।
৪.
২০২০ সালে আফ্রিকার দেশগুলো রাশিয়া থেকে চার বিলিয়ন বা চার শ কোটি ডলারের কৃষিজাত পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই গম। সবচেয়ে বেশি গম আমদানি করে মিসর। এর পরেই রয়েছে সুদান, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া, আলজেরিয়া, কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
একইভাবে, ওই বছরেই ইউক্রেন ২.৯ বিলিয়ন বা ২৯০ কোটি ডলারের কৃষিজাত পণ্য আফ্রিকায় রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ গম, ৩১ শতাংশ ভুট্টা এবং বাকি সূর্যমুখী তেল, বার্লি ও সয়াবিন।
চলমান যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্যের চালান যদি ঠাকমতো না পৌঁছায় বা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। এতে বেড়ে যাবে দামও। আফ্রিকার অনেক পরিবারে হয়তো চুলা জ্বলবে না।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। এই অবরোধ আফ্রিকা-রাশিয়া বাণিজ্য সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যাবে, তা এখনো বোঝা কঠিন। তবে জ্বালানি তেলের দাম দ্রুত বেড়ে যাবে। চরমভাবে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে পড়বে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতি।
আফ্রিকার জন্য তাই সামনে সুসময় অপেক্ষায় নেই। যদিও সমস্যা আর আফ্রিকা যেন হাত ধরাধরি করে পথ হেঁটেছে। সহস্র সমস্যা মোকাবিলা করেই এত দূর এসেছে আফ্রিকা।
যেকোনো সংকটে নতুন নতুন বিকল্প সামনে আসে। আফ্রিকাকেও এখন বিকল্প অনুসন্ধানে নামতে হবে। খুঁজতে হবে নতুন বাজার। তরুণ প্রজন্মের আফ্রিকান নেতারা কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন, তা–ই এখন দেখার রইল।
ই-মেইল: alim.zaman@prothomalo.com