আমার সহপাঠী ভিক্তর সাবেক ইউক্রেনীয় কূটনীতিক, বছর দুয়েক হলো অবসর নিয়েছে। ই-মেইলে সে আমাকে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে যুদ্ধ যুদ্ধ বলে নাকাড়া বাজিয়ে চলেছে, অবস্থা তেমন নয়। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ শহরে সবকিছুই আগের মতো, দোকানপাটে অস্বাভাবিক কেনাকাটার কোনো লক্ষণ নেই। যুদ্ধ যদি শেষ পর্যন্ত বেধেই যায়, তার ফল রাশিয়ার জন্য ভালো হবে না। আজকের ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ২০১৪ সালের সেনাবাহিনী এক নয়। ‘আমরা প্রস্তুত, বিনা লড়াইয়ে জায়গা ছাড়ব না,’ ভিক্তর লিখেছে।
সত্তরের দশকে প্রথম খারকভ, পরে কিয়েভ শহরে ছাত্র হিসেবে বছর ছয়েক কাটানোর সময় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মারাত্মক কোনো দ্বন্দ্ব রয়েছে, আমার তা মনে হয়নি। একটি জাতীয়তাবাদী ধারা হয়তো ছিল, কিন্তু তা নজরে পড়ার মতো নয়। এক রাষ্ট্র, এক পার্টি, এক ভাষা। আমরা সবাই রুশ ভাষাতেই কথা বলতাম, শহরে খুব প্রবীণ লোকজন ছাড়া ইউক্রেনীয় ভাষা তেমন শোনা যেত না। তা ছাড়া রুশ ও ইউক্রেনীয় উভয় ভাষাই স্লাভ গোত্রভুক্ত, তাদের মধ্যে তারতম্য তেমন প্রবল নয়। তবে উচ্চারণে কিছু হেরফের ছিল। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভ ইউক্রেনের মানুষ ছিলেন, তিনি ‘গ’ অক্ষরকে ‘হ’ হিসেবে উচ্চারণ করতেন। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে হাসাহাসিও হতো।
আজকের রাশিয়া এক হাজার বছর আগে ‘কিয়েভ রুশ’ সভ্যতার অংশ ছিল, অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্ম, যা রাশিয়ায় প্রচলিত, তা-ও এই কিয়েভ থেকেই পাওয়া। ফলে দীর্ঘদিন থেকে এই দুই জনপদ নানাভাবে একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর এই সম্পর্ক আরও নিকটতর হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সে রাজনৈতিক সম্পর্কে ছেদ পড়ে, কিন্তু আত্মিক সম্পর্কেও যে ছেদ পড়েছে, ভিক্তরের চিঠি আমাকে সেদিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করল।
একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক স্রোতোধারা ইউক্রেনে তির তির করে হলেও বইছে, তার সামান্য পরিচয় আমি ছাত্রাবস্থায় পেয়েছিলাম। তারাস শেভচেঙ্কো ইউক্রেনীয় ভাষার সেরা কবি (পুশকিন যেমন রুশ ভাষার)। ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির তিনি প্রতীক, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদেরও। ১০ মার্চ, ১৮৬১ সালে তিনি আজকের সেন্ট পিটার্সবুর্গে মারা যান, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের দাবিতে তাঁর মরদেহ ইউক্রেনে এনে ৮ মে নতুন করে সমাহিত করা হয়। দিনটিকে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যাতে এই কবির স্মৃতিকে ঘিরে সোভিয়েতবিরোধী কোনো আন্দোলন দানা পাকাতে না পারে, সে জন্য ইউক্রেনে দিনটি পালন নিষিদ্ধ। শেভচেঙ্কোর নামানুসারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সামনে নির্মিত হয়েছিল বিশাল স্মৃতিসৌধ। এই দিনে যাতে কেউ শেভচেঙ্কোর এই স্মৃতিসৌধে ফুল না দেয়, সে জন্য স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীদের লিখিত নির্দেশ দেওয়া হতো।
মনে আছে, সে নির্দেশ অমান্য করে ফুল দেওয়ার জন্য আমাদের ক্লাসের একজন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। শুনেছি, তাকে ওডিশা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজের জন্য। আর কোনো দিন তার দেখা মেলেনি।
গত বছর জুলাই মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক লম্বা—প্রায় হাজার পাঁচেক শব্দের প্রবন্ধে ইতিহাসের নানা তথ্য-উপাত্ত হাজির করে দাবি করেন, রুশ ও ইউক্রেন আসলে একই দেশ, একই সভ্যতা। পশ্চিমা দেশগুলো সে ইতিহাস উপেক্ষা করে ইউক্রেনকে রাশিয়া থেকে আলাদা করে ফেলতে চাইছে। সে লেখায় পুতিন দাবি করেন, একমাত্র রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারির মাধ্যমে ইউক্রেনের পক্ষে প্রকৃত সার্বভৌমত্ব অর্জন সম্ভব।
অধিকাংশ পশ্চিমা ভাষ্যকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, পুতিন আসলে শুধু ইউক্রেন নয়, পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনর্গঠিত করতে চান। এর আগেও বহুবার তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করেছেন, বলেছেন, এটি ছিল বিশ শতকের সর্ববৃহৎ ভূরাজনৈতিক দুর্যোগ। ইউক্রেন ও অন্যান্য সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র সমাজতান্ত্রিক ঐক্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়াকে তিনি রাশিয়ার শরীর কেটে ফেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। লিখেছেন, ‘এক হাজার বছর বেশি সময় ধরে যেসব মানুষ আমাদের অঙ্গীভূত ছিল, তারা এখন বিচ্ছিন্ন। এটা মানা কঠিন।’
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার বাহ্যিক ফলও ছিল। একদিকে সোভিয়েত বলয়ভুক্ত অধিকাংশ দেশের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি, অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে রুশ সীমান্ত ঘেঁষে থাকা কয়েকটি দেশের ন্যাটোর সদস্য পদ গ্রহণ।
১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। শুধু স্বাধীনতা নয়, রাশিয়ার সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক ছেদ করে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে উদ্যোগী হয়। মস্কোর ইচ্ছা ছিল ইউক্রেন ও বেলারুশকে নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠিত হবে, স্বাভাবিকভাবে যার নেতৃত্বে থাকবে রাশিয়া। ইউক্রেন তাতে সম্মত হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিতে যে বহুজাতিক সাম্রাজ্য মস্কো গড়ে তোলে, তাতে ইউক্রেন ও অন্যদের অবস্থান কখনোই সমানাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। ফলে মস্কোর বজ্র আঁটুনি থেকে মুক্ত হওয়ামাত্রই সে হাত বাড়ায় পশ্চিম ইউরোপের দিকে। রাশিয়া তাকে যেকোনো সময় গিলে খেতে পারে, এই ভয় থেকে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ব্যাপারটাকে পুতিন এবং অধিকাংশ রুশ নাগরিক ইউক্রেনীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই দেখেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার বাহ্যিক ফলও ছিল। একদিকে সোভিয়েত বলয়ভুক্ত অধিকাংশ দেশের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি, অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে রুশ সীমান্ত ঘেঁষে থাকা কয়েকটি দেশের ন্যাটোর সদস্য পদ গ্রহণ। এর ফলে পোল্যান্ড বা রোমানিয়ার মতো দেশ শুধু যে ন্যাটোর সদস্য হয়ে যায়, তা-ই নয়, এসব দেশে ন্যাটো সৈন্য ও সমরাস্ত্র মোতায়েন করা হয়। দুই বছর আগে পোল্যান্ডে মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করার কথা উঠেছিল, নানা মহলের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি।
পূর্ব ইউরোপের নতুন ন্যাটো সদস্যদের যুক্তি, নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যই তারা এই পশ্চিমা সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাশিয়ার নাম নেই, কিন্তু সাবেক সোভিয়েত সাম্রাজ্যভুক্ত দেশগুলো সে কথাই বুঝিয়েছিল। একই কারণে ইউক্রেনও ন্যাটোতে যোগ দিতে আগ্রহী। দেশটি জানে পুতিনের নেতৃত্বে নব্য রাশিয়া তার পুরোনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে আগ্রহী। হাত বাড়ালে সবার আগে ইউক্রেনই মস্কোর খাদ্যে পরিণত হবে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলে রুশ সৈন্য পাঠানোর পর এই ভয় আরও বেড়েছে।
কিন্তু মস্কো কোনোভাবেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত দেখতে চায় না। নিজের গায়ে লাগানো দেশ, সেখানে যদি ন্যাটোর সৈন্য বা সমরাস্ত্র মোতায়েন করা হয়, তার ফলে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ফলে বিষয়টি রাশিয়ার জন্য ‘রেড লাইন’। এই দাবির বিপরীতে ওয়াশিংটনের বক্তব্য, ন্যাটো ‘খোলা দরজা’ নীতি অনুসরণ করে, কোন দেশ এই সামরিক জোটে অংশ নেবে, সেটি তাদের ব্যাপার। এ প্রশ্নে ভেটো দেওয়ার অধিকার নেই মস্কোর।
রাশিয়া পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছে, ১৯৯০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের সময় ওয়াশিংটন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জার্মানির বাইরে পূর্ব ইউরোপ অভিমুখে ন্যাটো সম্প্রসারিত হবে না। ইউরোপের নিরাপত্তা অবিভাজ্য, এই কারণে ন্যাটোর কাঠামো বদলে রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে এই অঞ্চলের জন্য একটি নতুন নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তোলা হবে। কিন্তু পশ্চিমা জোট সে কথা কেবল রাখেনি, তা-ই নয়, নতুন পূর্ব ইউরোপীয় সদস্যদের মাধ্যমে তারা রাশিয়াকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে।
সত্যি কি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মস্কোর দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছেন। ১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করায় ওয়াশিংটন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, এটি তার উঠানে অস্ত্র রাখার শামিল। ইউক্রেন রাশিয়ার উঠান, সে যদি ন্যাটোর সদস্য হয়, তাহলে সেই একই ঘটনা ঘটবে। ২০১৮ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সেন্ট পিটার্সবুর্গে এক সম্মেলনে স্বীকার করেন, রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা জোট সদাচরণ করেনি। এর ফলে পশ্চিমের ব্যাপারে রাশিয়ায় যে সন্দেহ ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, তা অযৌক্তিক নয়।
শুধু ন্যাটোর সদস্য পদের আবেদন নয়, ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়া, বিশেষত এর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মাথাব্যথার আরও একটি কারণ রয়েছে। যত দিন পর্যন্ত কিয়েভে একটি মস্কোপন্থী সরকার ক্ষমতায় ছিল, পুতিনের উদ্বেগের তেমন কোনো কারণ ছিল না। অবস্থা বদলে গেল ২০০৪ সালের ‘অরেঞ্জ রেভল্যুশনের’ পর। সে বিপ্লবের লক্ষ্য গণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠন হলেও একটি অভিন্ন দাবি ছিল ইউক্রেনকে মস্কোর প্রভাবমুক্ত করে পশ্চিম ইউরোপের নিকটতর করে আনা। এই বিপ্লবের ফলে সেখানে একটি পশ্চিমঘেঁষা সরকার গঠিত হয়, যা খোলামেলাভাবে পুতিনের নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। রুশ লেখক মিখাইল জিগারের কথায়, পুতিনের জন্য এই বিপ্লব ছিল ‘ব্যক্তিগত অপমান’। তখন থেকেই তাঁর চেষ্টা ছিল মস্কোর কথায় ওঠবস করবে, ইউক্রেনে এমন একটি সরকার গঠন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল ও দেশের পূর্বাঞ্চলে সংখ্যাধিক্য রুশভাষীদের নিয়ে দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘প্রজাতন্ত্র’ দানিয়েস্ক ও লুগানস্ক গঠন সেই চেষ্টারই অংশ।
শুধু ইউক্রেন বা অন্যান্য সোভিয়েত বলয়ভুক্ত নব্য স্বাধীন দেশগুলোই নয়, নিজ দেশেও যাতে হলুদ, নীল বা কমলা রঙের বিপ্লব না হয়, পুতিন তা নিশ্চিত করতেও আগ্রহী। গত মাসে কাজাকিস্তানে সে রকম একটি বিপ্লব সম্ভাবনা দেখামাত্র পুতিন সেখানে সৈন্য পাঠিয়ে পরিস্থিতির শামাল দিয়েছেন।
অধিকাংশ পশ্চিমা ভাষ্যকার মনে করেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যভুক্তি ঠেকাতে মস্কো যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। সে উদ্দেশ্যেই তারা দুই দেশের সীমান্তে সোয়া লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছে। সরাসরি যুদ্ধ যদি না-ও করে, মস্কো নিদেনপক্ষে তার প্রতি অনুগত একটি সরকার গঠনের চেষ্টায় কিয়েভের জেলেনস্কি সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে।
বিষয়টি সম্ভবত এমন সরল নয়। ক্রেমলিনের ভাষ্য অনুসারে, রাশিয়া নয়, ইউক্রেনই যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে। ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা সে তৎপরতার অংশ। কথাটা হাস্যকর, কারণ, পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার কবজির জোর ইউক্রেনের নেই। কিয়েভ ন্যাটোর সদস্য হতে চায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে তার সে সদস্য পদ লাভের সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। সব সদস্যের সম্মতির ভিত্তিতে এই সামরিক জোটে সদস্য পদ অর্জন সম্ভব, কিন্তু ইউক্রেনের ব্যাপারে ন্যাটোর চলতি সদস্যদের মধ্যে কোনো মতৈক্য নেই। শিগগিরই সে মতৈক্য অর্জনের কোনো সম্ভাবনাও নেই। তা সত্ত্বেও মস্কো যে ইউক্রেন সীমান্তে সোয়া লাখ সৈন্য সমাবেশ করেছে, তার প্রধান কারণ, পুতিন হিসাব কষে দেখেছেন, পশ্চিমের কাছ থেকে চাপ দিয়ে কিছু অর্জনের এটাই সবচেয়ে মোক্ষম সময়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই মুহূর্তে ঘরে-বাইরে বিপদের মুখে রয়েছেন। পশ্চিমা জোটেও চলছে বিভক্তি। জার্মানিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। শীতকালে সে নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিলেও তারা, বিশেষত জার্মানি, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে অতি আগ্রহ দেখাবে না।
কোনো কোনো রুশ বিশেষজ্ঞও এখন এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত। আনাতোলি লুকিয়ানভের মতো অভিজ্ঞ রুশ পণ্ডিতের ধারণা, পুতিনের লক্ষ্য যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের হুমকি দেখিয়ে পশ্চিমের কাছ থেকে কিছু ‘কনসেশন’ আদায়। যেমন ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হবে না, এই প্রতিশ্রুতি। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সমরাস্ত্র বা সৈন্য মোতায়েন হবে না, মস্কো সে প্রতিশ্রুতিও চায়। লুকিয়ানভের মতে, পুতিন আরও একটা নিশ্চয়তা চান, আর তা হলো বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সম্মান। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়াশিংটনের চোখে মস্কো কোনো পরাশক্তি নয়, বড়জোর একটি প্রধান শক্তি। প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুটা হালকাভাবেই রাশিয়াকে ‘মেজর পাওয়ার’ নামে অভিহিত করেছিলেন। পুতিন সেই অপমানের বদলা চান।
রুশ ভাষ্যকার তাতিয়ানা স্তানোভাইয়া লিখেছেন, গত ৩০ বছরে এই প্রথম পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিবেচ্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মাখোঁর মতো নেতারা রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দাবি কার্যত মেনে নিয়েছেন। অন্য কথায়, খেলায় এগিয়ে পুতিন।
বলা যায়, একটা গুলি না ছুড়েও পুতিন তার অধিকাংশ দাবি আদায় করে ছেড়েছেন। তাঁকে খুশি করতে একের পর পশ্চিমা নেতারা মস্কো ছুটে আসছেন। ওয়াশিংটন ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি প্রশ্নে কোনো আপস করতে রাজি না হলেও রাশিয়ার ন্যায্য নিরাপত্তা দাবিগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনায় আগ্রহী বলে জানিয়েছে। রুশ ভাষ্যকার তাতিয়ানা স্তানোভাইয়া লিখেছেন, গত ৩০ বছরে এই প্রথম পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিবেচ্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মাখোঁর মতো নেতারা রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দাবি কার্যত মেনে নিয়েছেন। অন্য কথায়, খেলায় এগিয়ে পুতিন।
এই মুহূর্তে রাশিয়ার জন্য একটি অতিরিক্ত সুবিধা, সে চীনকে নিজের পাশে পেয়েছে। ন্যাটোর চাপের মুখে মস্কো ক্রমাগত চীনের দিকে ঝুঁকছে। চীনা প্রেসিডেন্ট সি ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যৌথভাবে ন্যাটোর বিরুদ্ধে নতুন ব্লক গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
পুতিন যদি তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য অর্জন করে থাকেন, তাহলে এখনো কেন ইউক্রেনের সীমান্তে সোয়া লাখ সৈন্য? কারণ, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এখনো তাঁর ত্যাড়া ঘাড় বাঁকা করেই বসে আছেন। সম্ভব হলে তাঁকে হটিয়ে অনুগত কাউকে সেখানে বসানো পুতিনের ইচ্ছা। তা যদি এই মুহূর্তে সম্ভব না হয়, অন্ততপক্ষে তিনি যেন ন্যাটোমুখী হওয়া থেকে বিরত থাকেন, পুতিন তা-ই চান। পুতিনের আরেক ইচ্ছা, ইউক্রেন বিচ্ছিন্নতাবাদী দুই ইউক্রেনীয় ‘স্বাধীন প্রজাতন্ত্র’কে (দানিয়েস্ক ও লুগানস্ক) মেনে নিক। নিদেনপক্ষে তাদের ‘বিশেষ অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিক।
২০১৪ সালে এই দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার পর জার্মানি ও ফ্রান্সের দূতিয়ালিতে ২০১৫ সালে মস্কো ও ইউক্রেন একটি শান্তি চুক্তি সই করে। ‘মিনস্ক মতৈক্য’ নামে পরিচিত সেই চুক্তি অনুসারে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসার ব্যাপার ইউক্রেন সম্মত হয়। মস্কোর ভাষ্য অনুসারে, এই আলাপ-আলোচনার লক্ষ্য এই দুই অঞ্চলের আংশিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নেওয়া। সাত বছর আগে স্বাক্ষরিত হলেও এই চুক্তি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, কিয়েভ সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো স্বীকৃতিও দেয়নি।
কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, মিনস্ক চুক্তি মেনে নিলেই সব ল্যাটা চুকে যায়। কিন্তু রাশিয়ার শর্তে যদি তা মানা হয়, তার অর্থ দাঁড়াবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব মস্কোর পদানত করা।
প্রেসিডেন্ট পুতিন এই মিনস্ক চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চান। গত সপ্তাহে মস্কোতে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি সে কথার পুনরুক্তি করেন। তিনি বলেন, জেলেনস্কি জানিয়েছেন, এই চুক্তির কোনো শর্তই তাঁর পছন্দ নয়, কিন্তু এই চুক্তির বাস্তবায়িত না হলে তিনি শেষমেশ নিজের দেশই হারাবেন। জেলেনস্কিকে তিনি ‘মাইয়া ক্রাসাভিৎসা’ নামে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমার পছন্দ হোক বা না হোক, এই চুক্তি বাস্তবায়ন তোমার দায়িত্ব।’
মাইয়া ক্রাসাভিৎসা কথাটার আক্ষরিক অর্থ ‘হে আমার সুন্দরী’। ছাত্রাবস্থায় কাউকে ঠাট্টা করে আমরা ‘মাইয়া ক্রাসাভিৎসা’ (ডার্লিং) বলেছি, কিন্তু পুতিন যেভাবে কথাটা বলেন, তাতে ঠাট্টা নয়, স্পষ্ট অবজ্ঞা ও ঘৃণা মেশানো ছিল। চাইলে তিনি ইউক্রেনকে হাসতে হাসতে পিষে ফেলতে পারেন, কার্যত সেই হুমকিই তিনি দিলেন।
কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, মিনস্ক চুক্তি মেনে নিলেই সব ল্যাটা চুকে যায়। কিন্তু রাশিয়ার শর্তে যদি তা মানা হয়, তার অর্থ দাঁড়াবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব মস্কোর পদানত করা। বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দুটিকে যদি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে দেশের ভেতরে যে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হবে, তার ফলে জেলেনস্কির পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব হবে।
এই সংকট থেকে বেরোনোর একটি সরল পথ বাতলেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। সেই ২০১৪ সালেই তিনি লিখেছিলেন, নিজের স্বার্থেই ইউক্রেনের উচিত হবে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বলয় থেকে নিজেকে দূরে রাখা। রাশিয়ার উচিত হবে ইউক্রেনকে নিজ বলয়ভুক্ত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। কারণ, সে চেষ্টার ফলে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক বিবাদে জড়িয়ে পড়বে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোরও উচিত হবে ইউক্রেনকে ন্যাটোর ভেতর টেনে না আনা। রাশিয়ার কাছে সে কখনোই ‘বিদেশি’ কোনো দেশ হবে না। নিজের জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে মস্কোর যে ন্যায়সংগত উদ্বেগ রয়েছে, তা মেনে নিয়ে এগোলেই সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।
যুদ্ধ যুদ্ধ বলে ওয়াশিংটন যতই চেঁচাক, এই মুহূর্তে গাড়ির চালকের আসনে মস্কো। তার লক্ষ্য যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের ভান করে নিজের দাবি আদায় করে নেওয়া। তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সে শিগগির নিজ সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবে, তা মনে হয় না।