প্যারিসের প্লাস দো লা রিপাবলিক স্কয়ারের প্রধান ভাস্কর্য হিসেবে মারিয়ানের যে মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, তার এক হাতে শান্তির প্রতীক জলপাইয়ের শাখা, অন্য হাতে একটি বই। বইয়ের মলাটে লেখা ‘মানবাধিকার’। এর মাধ্যমে ফরাসি প্রজাতন্ত্র বিশ্বকে এই বার্তা দিয়ে আসছে যে তারা শান্তি ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী।
কিন্তু মারিয়ানের মূর্তি আসলেই ফ্রান্সের বর্তমান বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ফ্রান্স তো বটেই, গোটা ইউরোপের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
স্তম্ভিত, শোকাহত প্যারিসবাসী রিপাবলিক স্কয়ারে ফুল দিয়ে কিংবা মোমবাতি জ্বালিয়ে জঙ্গি হামলায় নিহত মানুষের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ তাৎক্ষণিকভাবে যে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে মনে হয় যেন এই মুহূর্তে তিনি মারিয়ানের এক হাতে জলপাই শাখার বদলে রাইফেল আর অন্য হাতে ‘মানবাধিকার’ নামাঙ্কিত বইয়ের বদলে নতুন সন্ত্রাস দমন আইনের পুস্তিকা দেখলে খুশি হতেন। ফ্রান্সের রাজনীতি এমনই একটি ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। প্যারিসের এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ওলাঁদ যে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন, হয়তো তাই আগামী কয়েক মাস বা বছরে ফ্রান্স, এমনকি পুরো ইউরোপের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ধরন বাতলে দেবে।
ফ্রান্সে ইতিপূর্বে ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি এবদোর কার্যালয় এবং সেই সঙ্গে ইহুদিদের সুপারমার্কেটে হামলার পর ঘটনার শিকার হওয়া সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের অনুভূতির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিল দেশটির সাধারণ মানুষ। তারা ‘আমরা সবাই শার্লি’ স্লোগানে তাদের হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করেছিল।
গত শুক্রবার রাতে হামলা হয়েছে সংগীতানুষ্ঠান, ফুটবল স্টেডিয়াম ও রেস্তোরাঁর মতো জায়গায়। অর্থাৎ বিনোদন, খেলাধুলা, খাওয়াদাওয়া করতে আসাসহ সমাজের সব ধরনের মানুষের ওপর হামলা। হামলার ধরন ও সময় বিবেচনায় এখন ফ্রান্সের মানুষের সর্বজনীন স্লোগান হতে পারে, ‘আমরা সবাই (সন্ত্রাসীদের) নিশানায় আছি’।
এ রকম পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের মানুষ সমাধানের আশায় চেয়ে আছে তাদের রাজনীতিকদের দিকে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদকে দেশটির ইতিহাসেই সবচেয়ে কম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধরা হয়। এক জরিপ অনুযায়ী, গত অক্টোবরের শুরুতে ওলাঁদের জনসমর্থন ছিল মাত্র ১৭ শতাংশ। তবে প্যারিস হামলার কড়া পাল্টা জবাব দেওয়ায় তাঁর প্রতি সমর্থন কিছুটা বেড়েছে।
ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এফএন) নেত্রী মারিন লো পেন ফ্রান্সের সীমান্ত আবার ‘নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে’ এবং আইএসের মতো কট্টর ইসলামপন্থীদের ‘ধ্বংস করতে’ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ইউরোপের অভিবাসননীতি নতুন করে তৈরি করার এবং ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস দাবি করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ এখনই অভিবাসন বিষয়ে চূড়ান্ত কঠোর কোনো সিদ্ধান্তে যাচ্ছেন না। তবে তিনি সম্ভবত সংবিধানে এমন সব সংশোধনী আনতে যাচ্ছেন, যার মাধ্যমে সরকার জঙ্গি দমনের বিষয়ে বহু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আর এর প্রভাব পড়তে পারে ইউরোপের বাকি দেশগুলোতেও।