ফ্রান্সে সদ্যসমাপ্ত জি-৭ সম্মেলনের সেরা পারফরমার কে?
একটুও না ভেবে চট করে বলে দেওয়া যায়—রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনিই এ বছরের জি-৭ সম্মেলনের সেরা পারফরমার। তিনিই বিজয়ী।
উত্তরটা ‘বোকা বোকা’ লাগছে নিশ্চয়ই। পাঠক হয়তো ভাবছেন, কী নাকি বলছি!
এমন ভাবনায় যুক্তি আছে মানছি। কারণ, রাশিয়া তো জি-৭ জোটের সদস্যই না। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের শাস্তি হিসেবে রাশিয়াকে সেই কবেই জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়। রাশিয়া বাদ যাওয়ার পর জি-৮ জোট হয়ে যায় জি-৭।
ফ্রান্সে গত মাসের শেষ ভাগে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশ্বনেতাদের মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সশরীরে হাজির না থাকলেও তাঁর ‘ছায়া’ ঠিকই ছিল। এই ছায়াই পুতিনের হয়ে কাজের কাজ করে দিয়েছে। ছায়ার বদৌলতেই একপর্যায়ে সম্মেলনের কেন্দ্রে চলে আসেন পুতিন।
বোঝাই যাচ্ছে, পুতিনের এই ছায়া বেশ শক্তিশালী। তো সেই ছায়া কে? তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর এই জোটে ট্রাম্প যে রাশিয়াকে ফের সদস্য হিসেবে দেখতে চান, সে কথা নতুন নয়। তবে জোটের অন্য সদস্যরা ট্রাম্পের এই বিশেষ চাওয়ার ব্যাপারে বরাবর বাগড়া দিয়ে আসছে।
কিন্তু এবার ট্রাম্প একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়েছেন। আগামী বছর জি-৭ সম্মেলনের আয়োজক যুক্তরাষ্ট্র। ২০২০ সালের সেই আয়োজন নিয়ে এখন একটু-আধটু কথা তো বলাই যায়।
ট্রাম্প চমক দিতে ভালোবাসেন। তাই আগাম চমক দিতে এবারের জি-৭ সম্মেলনে জোটের পরবর্তী আয়োজন নিয়ে কথা বলার সুযোগ হাতছাড়া করেননি ট্রাম্প। ভরা মজলিশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সগর্বে জানিয়ে দেন, জোটের আগামী সম্মেলনটি যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে নিজের ‘চমৎকার’ গলফ রিসোর্টে করতে চান তিনি।
ফ্রান্সে জি-৭ সম্মেলনে সবচেয়ে বড় যে চমকটি ট্রাম্প দেন তা হলো জোটের পরবর্তী সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উপস্থিতি খুব করে আশা করেন তিনি। এ জন্য তাঁকে সেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ট্রাম্পের এই ‘সারপ্রাইজ’ ঘোষণায় জি-৭ সম্মেলনের ‘আমেজ’ পুতিনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে। সব ছাপিয়ে চিন্তার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেন ‘পুতিন’।
ফ্রান্সের সাগরঘেঁষা বিয়ারিটজে শহরে নিজের বিশাল ‘ছায়া’ দেখতে পেয়ে সুদূর ক্রেমলিনে বসে মুচকি হাসেন পুতিন।
ফ্রান্সে বসে রাশিয়া ও তার প্রেসিডেন্টের পক্ষে ওকালতি করে ট্রাম্প জি-৭ সম্মেলনে উপস্থিত বিশ্বনেতাদের ভ্রু রীতিমতো কুঁচকে দেন। বিশ্বে কত কী সংকট। সেসব সংকট সমাধানে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতির খবর নেই। অথচ ট্রাম্প কিনা পড়ে আছেন রাশিয়া ও পুতিন নিয়ে। ফলে সম্মেলন শেষে লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে দেখা গেল, জোট থেকে বহিষ্কৃত দেশটিই (রাশিয়া) আসল ফায়দা তুলে নিয়েছে। এ জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার একমাত্র দাবিদার ট্রাম্প।
জি-৭ সম্মেলনে সবচেয়ে ‘বাজে ভূমিকা’ রাখায় নিজ দেশেও তোপে পড়েন ট্রাম্প। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান গোয়েন্দারা পর্যন্ত ট্রাম্পকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। একজনের ভাষ্য, সব দেখেশুনে মনে হয়, ওভাল অফিসে রাশিয়ার লোক (ট্রাম্প) বসে আছেন। কেউবা ট্রাম্পকে রুশ প্রেসিডেন্টের ‘পুতুল’ বলেও আখ্যা দেন।
পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের ‘গভীর প্রেম’ কবে থেকে শুরু, তার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ আমাদের জানা নেই। কারণ, ব্যবসায়িক ট্রাম্পকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না।
ট্রাম্প রাজনীতিতে নামার পরই চোখে লাগে, নির্বিচারে রূঢ় আচরণ করা এই লোকেরও একটা ‘দুর্বল পয়েন্ট’ আছে। পুতিনে মারাত্মক দুর্বল ট্রাম্প।
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানের পুরোটা সময় ট্রাম্পকে পুতিনের গুণ গাইতে দেখা যায়। পুতিনের প্রতি এই ‘গদগদ ভাব’ ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও অব্যাহত আছে। যার সবশেষ নমুনা দেখা গেল ফ্রান্সে জি-৭ সম্মেলনের আসরে।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ট্রাম্পের কথা অনেকেই গোনায় ধরতেন না। কিন্তু এখন তিনি ‘বিশ্ব মোড়ল’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি লোক যেমনই হোন না কেন, অন্তত পদের কারণে তাঁর কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না।
ট্রাম্পের নির্বাচনী স্লোগান ছিল, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’। কিন্তু প্রতিনিয়ত উল্টাপাল্টা বলে ও কাজ করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বারোটা বাজাচ্ছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনার সুযোগ নিচ্ছেন পুতিন। বিশ্বমঞ্চে তাঁর কাছে ট্রাম্প নবিশ মাত্র। একইভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে পুতিনের রাশিয়ার কাছে সকাল-বিকেল নাকানি-চুবানি খাচ্ছে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র।
ক্যাসিনো ব্যবসায় হাত পাকানো ট্রাম্প কি এসব বোঝেন না? নিজের চোখে তাঁর ও যুক্তরাষ্ট্রের অধোগতি দেখেন না?
সবকিছু উপেক্ষা করে পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের বিশেষ ‘টান’ রহস্যজনকই বটে। এই টানের কারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে এই রহস্যের একটা সম্ভাব্য সমাধান দিয়েছেন সিআইএ ও এনএসএর সাবেক শীর্ষ আইনজীবী রবার্ট ডাইটজ। ট্রাম্প তাঁর ব্যবসার কথা ভেবে পুতিনের টান টানছেন। পুতিনের সঙ্গে ভবিষ্যতে ব্যবসা করার পথ খোলা রাখার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো তাঁর কাছে ভালো মানুষটি হয়ে থাকা।
যিনি (ট্রাম্প) ব্যবসায়িক মডেলে প্রেসিডেন্সি চালান, তাঁকে নিয়ে অভিজ্ঞ ডাইটজের মত পুরোপুরি নাকচ করার উপায় কোথায়!