সাইবেরিয়ান হরিণের শিং থেকে নেওয়া রক্ত দিয়ে গোসল করা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা এড়াতে অনুগত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মলমূত্র সরিয়ে ফেলা। জরুরি চিকিৎসার জন্য রহস্যজনক অন্তর্ধান। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়ে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্যের দাবি করা হচ্ছে। আগামী অক্টোবরে ৭০ বছরে পা রাখতে যাওয়া পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়ে এমন তথ্য যাচাই করা অসম্ভবই বটে।
এএফপির প্রতিবেদনের মতে, এসব গুঞ্জন যে বিষয়টি তুলে ধরছে, সেটা হলো ইউরোপের ভবিষ্যতের জন্য যে নেতার স্বাস্থ্যগত অবস্থা জানা থাকাটা অপরিহার্য, সে বিষয়ে জানাশোনা কতটা কম। বিশেষ করে, তিনি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর নির্দেশ দেওয়ার পর বিষয়টি আগের যেকোনো সময়ের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক।
পুতিনের দুই দশকের এই শাসনকালে লক্ষণীয়ভাবে তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সামান্যই প্রকাশ্যে এসেছে। পৌরুষ শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে ক্রেমলিনের সরবরাহ করা খালি বুকের বিখ্যাত ছবিগুলো ছাড়া পুতিনকে নিয়ে তেমন কিছুই জানা যায় না।
তবে প্রতিবেশী ইউক্রেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পর পুতিনের স্বাস্থ্যগত বিষয় ঔৎসুক্য এখন বেড়েছে।
পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়ে এপ্রিলে সবচেয়ে গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রুশ ভাষার নিউজ পোর্টাল প্রোয়ক্ত। উন্মুক্ত উৎস থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যটন নগরী সোচিতে পুতিনের সফরের সময় সেখানে বড়সংখ্যক চিকিৎসকের একটি দলও ছিল।
এই চিকিৎসকদের মধ্যে ছিলেন থাইরয়েড ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ইয়েভগেনি সেলিভানভ। গত কয়েক বছর পুতিনের আকস্মিক জনসম্মুখে না আসার সময়গুলোয় তিনিও প্রায়শই সোচি সফরে থাকতেন।
বলা হয়ে থাকে, সাইবেরিয়ান হরিণের শিং থেকে নেওয়া রক্ত দিয়ে গোসল করেন পুতিন। দীর্ঘায়ু পেতে পুতিনের অনুসরণ করা কয়েকটি পদ্ধতির এটি একটি। পুতিনের বন্ধু সাইবেরিয়ায় জন্ম নেওয়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু তাঁকে এ পরামর্শ দিয়েছেন।
চলতি মাসে ফ্রান্সের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্যারিস ম্যাচ দাবি করেছে, ২০১৯ সালে সৌদি আরব এবং ২০১৭ সালে ফ্রান্স সফরের সময় পুতিনের সঙ্গে একটি দল ছিল। যখনই তিনি টয়লেটে যেতেন, তাঁর মলমূত্রগুলো তারা সংগ্রহ করে ফেলত, যাতে বিদেশি কোনো শক্তির হাতে না পড়ে। কারণ, মলমূত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁর স্বাস্থ্যগত অবস্থা অন্যরা জেনে যেতে পারে।
এমনকি আরও চাঞ্চল্যকর দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে জুনে ম্যাগাজিনটি বলেছে, এপ্রিলে উচ্চমাত্রার ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছিলেন পুতিন। অবশ্য এ ধরনের তথ্য নিয়ে অভ্যন্তরীণ ব্রিফিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল।
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল কিরিলো বুদানভ মধ্য মে মাসে স্কাই নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পুতিন ক্যানসারে আক্রান্ত বলে দাবি করেন। তবে দাবির সপক্ষে তিনি কোনো তথ্য-প্রমাণ দেননি।
এখন পর্যন্ত কেবল একবারই পুতিনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা জানিয়েছে ক্রেমলিন। আর সেটা ছিল ২০১২ সালের শরতে। অস্বাভাবিকভাবে হাঁটতে দেখা যাওয়ার পর তিনি কয়েকটি বৈঠক বাতিল করেন এবং আড়ালে চলে যান।
ওই সময় ক্রেমলিন বলেছিল, পুতিন পেশিতে চোট পেয়েছেন। একটি পত্রিকা জানায়, মোটরচালিত একটি হ্যাং-গ্লাইডারে উড়ার সময় স্টান্ট নিতে গিয়ে তাঁর পিঠে সমস্যা হয়। তবে প্রোয়ক্ত বলছে, এটাই ছিল তাঁর বড় স্বাস্থ্য জটিলতার শুরু।
করোনার সময়ও রুশ নেতার কিছু অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়। ক্রেমলিন জানায়, তিনি টিকা নিয়েছেন। তবে বিশ্বের অন্যান্য নেতার মতো তাঁর টিকা নেওয়ার মুহূর্তের ছবি প্রকাশ করা হয়নি। সাংবাদিকসহ তাঁর সংস্পর্শে আসা লোকজনকে কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোর মতো কঠোর পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হতো।
বৈশ্বিক নেতাদের যাঁরা ক্রেমলিনের এই কঠোর শর্ত মানতেন না, তাঁদের বিশাল একটি টেবিলের অন্য প্রান্তে দীর্ঘ দূরত্বে বসানো হতো। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছিল।
রাশিয়ায় গিয়ে কোভিড-১৯ পরীক্ষা এবং সম্ভবত কোয়ারেন্টিনের মতো ক্রেমলিনের শর্তগুলো মানলে সেসব নেতাদের সঙ্গে করমর্দন, ক্ষেত্র বিশেষ কোলাকুলিও করতেন পুতিন। এই নেতাদের মধ্যে ছিলেন আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান।
এপ্রিলের শেষ দিকে ইউক্রেন নিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুর সঙ্গে পুতিনের এক বৈঠক গুঞ্জনের পালে আরও হাওয়া দেয়। এতে পুতিনকে শক্ত করে টেবিল ধরে রাখতে দেখা যায়। কেউ কেউ বলছেন, এটা পুতিনের শরীরের কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা ছিল। অনেক ভিডিওতে দেখা যায়, বৈঠকের সময় পুতিনের পা অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট কোনো ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন এমন সব দাবি দ্ব্যর্থহীনভাবে অস্বীকার করেছেন পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। ফরাসি টেলিভিশন চ্যানেল টিএফ১-কে মে মাসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে সুর আরও চড়া করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। পুতিনের অসুস্থতার বিষয়টি অস্বীকার তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, মানসিকভাবে সুস্থ কোনো লোক এই ব্যক্তির মধ্যে কোনো ধরনের রোগ কিংবা অসুস্থতার লক্ষণ দেখতে পাবেন।’ রুশ নেতা প্রতিদিনই জনসম্মুখে আসছেন বলেও দাবি করেন লাভরভ।
সম্প্রতি পিটার দ্য গ্রেট নিয়ে একটি ফোরামে উপস্থিত ছিলেন পুতিন। তুর্কমিনিস্তানের প্রেসিডেন্ট সেরদার বারদিমুখামেদভের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। এসব অনুষ্ঠানে পুতিনের শারীরিক কোনো দুর্বলতা চোখে পড়েনি।
পুতিন রাশিয়ার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আছেন। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, ২০২৪ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন তিনি। সাম্প্রতিক সাংবিধানিক পরিবর্তন তাঁকে এ সুযোগ করে দিয়েছে।
বলার মতো পুতিনের কোনো উত্তরসূরি তৈরি হয়নি রাশিয়ায়। রুশ বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর সিদ্ধান্তও তাঁর।
প্রোয়ক্তের এডিটর-ইন-চিফ রোমান বাদানিন বলেন, যে লোকটি দেশটি চালাচ্ছেন তাঁর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটি শব্দ সত্যও জানে না দেশ। যে লোকটি একটি লাল বোতাম চাপ দিয়ে গোটা মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন, গোটা দুনিয়া জানে না সেই লোকটি সুস্থ কি না।